মিষ্টি মূহুর্ত [৬ষ্ঠ পর্ব][২]

লেখক :— a-man & বিচিত্রবীর্য
Typist :— বিচিত্রবীর্য

“ বাহ্ ভালো খবর। এখন কত বয়স গোধূলির ? „ কম বয়সে ছেলের বিয়ে দেওয়াটা এখনও ঠিক মেনে নিতে পারেননি তিনি। তার উপর একটা সামান্য কুষ্ঠির কথা মেনে এইসব করাটাকে কুসংস্কার বলে। তবুও ভালো যে নাবালকের বিয়ে দিতে হচ্ছে না। এতকিছুর মধ্যে এটাই একটু শান্তি দিচ্ছে। এখন যদি গোধূলি নাবালিকা হয় তাহলে তো তাকে বেঁকে বসতেই হবে।
সঞ্জয় একটু ভেবে নিয়ে বললো , “ এখন একুশ চলছে আর কয়েক মাস পর বাইশে পড়বে। কেন জিজ্ঞাসা করছেন জানতে পারি কি ! „
গোধূলি নাবালিকা নয় শুনে একটা ভার বুক থেকে নেমে গেল । একটা বড়ো নিশ্বাস ফেলে বললেন , “ তুমি জানো আকাশের তেইশ বছর হলেই তোমার বৌদি ওর বিয়ে দেবে। কালকেই ও গোধূলির কথা জিজ্ঞাসা করছিল…..
সঞ্জয় চোখ বড়ো বড়ো করে জিজ্ঞাসা করলো , “ মানে বৌদিও রাজি এই সম্পর্কে ? „
আকাশের মায়ের জিজ্ঞাসাটাই তিনি সঞ্জয়ের কাছে বললেন , “ বিদেশে থেকে বড়ো হয়েছে। কোন বদ অভ্যাস , মানে নেশা পার্টি এমন কিছু …..
মুখের সামনে থেকে মাছি তাড়াচ্ছে এমন ভাবে মুখের সামনে দিয়ে হাত নাড়িয়ে সঞ্জয় বললো , “ আরে না , না , আমার মেয়েকে দেখলেই বুঝবেন। ওর এইসব বদ অভ্যাস নেই । „
সঞ্জয়ের হাবভাব দেখে হেসে নিয়ে আকাশের বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, “ তোমার স্ত্রী চারুলতা রাজি ? মেয়ের এত কম বয়সে বিয়ে দেওয়া নিয়ে ? „
আকাশের বাবার হাসিকে পাত্তা না দিয়ে সঞ্জয় বললো , “ না , ওর কোন অসুবিধা নেই। পাত্র ভালো হলেই সাত খুন মাফ ওর কাছে । „
মাথাটা সামনে পিছনে একবার নাড়িয়ে আকাশের বাবা বললেন , “ বুঝেছি । „
দুই দিন পর মাস শেষ হয়ে গেলে সুচির অনেক দিনের একটা স্বপ্ন পূরণ করার সময় হয়ে এল। সুচি বেতন হাতে পেয়েই কৌশিককে নিয়ে গিয়ে শোরুম থেকে হলুদ রঙের Honda activa কিনে নিল।
এক সপ্তাহ পরেই সঞ্জয় তার মেয়েকে নিয়ে অফিসে ঢুকলো। আকাশ প্রথম দেখায় চিনতেই পারলো না গোধূলিকে। সঞ্জয় সবার সাথে তার মেয়ের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় আকাশ চেয়ারে বসে গোধূলিকে দেখতে লাগলো। একটা লাল রঙের ফুল গাউন পড়ে আছে। উচ্চতা 5’3″ – 5’4″ হবে। ঘন কালো চুল পনিটেল করা। গাল দুটো এখন আগের থেকে বেশিই লাল। চোখ দুটো পাহাড়িদের মত অতোটা সরু নয় তাই এই ফর্সা লাল টমেটোর মতো মুখে ওই চোখ দুটো মুখের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। যৌবনের ছাপ গাউনের উপর ফুটে আছে আর সেটা অফিসের ইয়ং ছেলেদের আড় চোখে তাকানোর কারন হচ্ছে।
অফিসে ঢুকে সঞ্জয়কে দেখে সবাই উঠে দাঁড়ালেও আকাশ উঠে দাড়ায়নি তাই গোধূলির দৃষ্টি মাঝেমাঝেই আকাশের উপর চলে যেতে লাগলো । আকাশকে এক কোনায় একটাচেয়ারে বসে থাকতে দেখে গোধূলি মনে করলো অর্থাভাবে জর্জরিত কোন দুঃখী পরিবারের সন্তান যে এই অফিসের পিওনের কাজ করছে।
অফিসের বাকি সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর যখন সঞ্জয় গোধূলিকে নিয়ে আকাশের কাছে এলো তখন গোধূলি যে অবাক হয়েছে সেটা তার চোখে মুখে ফুটে উঠলো। সঞ্জয় মেয়েকে বললো , “ চিনতে পারছিস ? „
বাবার কথা শুনে গোধূলি বুঝতে পারলো যে সে আকাশকে আগে দেখেছে কিন্তু এখন চিনতে পারছেন না , তাই মাথা দুই দিকে নাড়িয়ে সে বললো , “ না ! „
সঞ্জয় একটু হেসে বললো , “ আকাশ । চিনতে পারলি না ! „
গোধূলি আর সঞ্জয় যখন আকাশের কাছে এগিয়ে এসছিল তখনই আকাশ উঠে দাড়িয়ে ছিল। এখন হাত তুলে মুখে হাসি নিয়ে সে বললো , “ Hi „
আকাশের নাম শোনার পর আকাশকে চিনতে না পারার জন্য গোধূলির মুখে লজ্জা ফুটে উঠলো , “ তুমিই আকাশ ! আমি তো চিনতেই পারি নি । এখানে বসে কেন ? „
আকাশের এখন আর লজ্জা লাগে না বলতে তাই সে অকপটে সত্য কথাটাই বলে দিল , “ আমি এখানে পিওনের কাজ করছি । „
পিওনের কাজ শুনেই গোধূলির ভুরু কুঁচকে গেল , গলায় বিস্ময় ঝড়ে পড়লো , “ মানে ! তুমি পিওনের কাজ ! বুঝতে পারছি না কিছু ! „
সঞ্জয় এদের কথা থামিয়ে বললো , “ তোমাদের কথা পরে অনেক হবে । আয় আগে তোকে আকাশের বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই । „
আকাশ বললো , “ পরে কথা হবে । „
গোধূলিকে নিয়ে সঞ্জয় আকাশের বাবার কেবিনে ঢুকলে গোধূলি আকাশের বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে করতে জিজ্ঞাসা করলো , “ কেমন আছেন আংকেল ? „
“ আরে কি করছো কি তুমি ! পায়ে হাত দেয় নাকি কেউ ! আমি ভালো আছি । তুমি কেমন আছো ? „
“ আমিও ভালো আছি। বাইরে আকাশকে দেখলাম। বললো পিওনের কাজ করছে। বুঝলাম না ঠিক ! „
“ সে তুমি ওকেই জিজ্ঞাসা করো । „ তারপর সঞ্জয়ের দিকে ফিরে বললেন , “ অনেক বড়ো হয়ে গেছে চেনাই যাচ্ছে না। সেই ছোটবেলায় দেখেছিলাম। „
সঞ্জয় একটু হেসে নিয়ে মেয়েকে বললো , “ চল আমার কেবিনে । „
আকাশকে জিজ্ঞাসা করার পর আকাশের কাছ থেকে উত্তর শোনার আগেই বাবা তাকে ওখান থেকে নিয়ে চলে এসছে। এখন আবার আকাশের বাবাকে জিজ্ঞাসা করার পরেও তার বাবা তাকে এখান থেকে নিয়ে চলে যেতে চাইছে। নিশ্চয়ই কোন কারন আছে । না হলে বাবা এরকম করবে না । এটা ভেবেই গোধূলি সঞ্জয়ের পিছন পিছন আসতে আসতে আকাশের বাবার উদ্দেশ্যে বললো , “ আসছি আংকেল । „
আকাশের বাবা চেয়ারে বসতে বসতে বললেন , “ হ্যাঁ এসো । „
গৌধুলি আকাশের বাবার কেবিন থেকে বার হয়ে , বাবার পিছন পিছন গিয়ে বাবার কেবিনে ঢুকলো। চেয়ারে বসে সঞ্জয় জিজ্ঞাসা করলো , “ কেমন লাগলো অফিস ? „
“ এখানে এসে দারুণ লাগছে। কিন্তু আকাশের ব্যাপারটা বুঝলাম না । „
সঞ্জয় বিদ্রুপ করে বললো , “ ওকে এখন ওর বাবা পিওনের কাজে লাগিয়েছে। ভাব একবার … নিজের ছেলেকে দিয়ে এইসব করাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করেছিলাম , তখন বললো নাকি ছেলেকে নিজের হাতে গড়তে চান । „
বাবার কথা শুনে গোধূলির ভুরু আরও কুচকে গেল , “ এতে আকাশের কোন আপত্তি নেই ? মানে এতো বড়ো কোম্পানির ওয়ারিশ । সে নিজের কোম্পানিতে পিওনের কাজ করছে ! „
“ আপত্তি আছে কি না জানি না । হয়তো বাড়িতে কথা হয় এই নিয়ে । তুই ওকেই জিজ্ঞাসা করিস , তবে এখন না। টিফিন আওয়ারে কথা বলিস। এখন কাজ না করে গল্প করলে আকাশের বাবা আবার রেগে যায়। „
টিফিন আওয়ারে আকাশ বাবার সাথেই খাওয়া দাওয়া করে। আজকে সঞ্জয় সেটা হতে দিল না। আড়াইটে বাজতেই সে আকাশের বাবার কেবিনে ঢুকে আকাশের বাবাকে বললো , “ আজকে ওদের একসাথে খেতে দিন। একসাথে খেলে আলাপ করতে পারবে । এতে আমাদেরই সুবিধা । „
আকাশের বাবা হাসলেন কিন্তু কিছু বললেন না। আকাশ হাত ধুয়ে বাবার কেবিনে ঢুকলে তিনি তার টিফিন কৌটটা ছেলেকে দিয়ে বললেন , “ আজ তুই গোধূলির সাথে খেয়ে নে । আমার খিদে নেই । „
আকাশকে কিছু বলতে দেওয়ার আগেই সঞ্জয় বললো , “ তুমি আমার কেবিনে চলে যাও। ওখানেই গোধূলি আছে । „
আকাশ আর কিছু না বলে টিফিন কৌটটা নিয়ে চুপচাপ চলে এলো । সঞ্জয়ের কেবিনে ঢুকতেই গোধূলি জিজ্ঞাসা করলো , “ তুমি ! „
“ হ্যাঁ আমি। তোমার বাবা এখানে পাঠিয়ে দিলেন। বাবার মনে হয় কাকার সাথে কোন কাজ আছে । তাই এখানে এসে খেতে বললো । „
“ ও বসে পড়ো । „ বলে গোধূলি পাশের চেয়ারটা দেখিয়ে দিল।
আকাশ সেখানে বসলে গোধূলি বললো , “ তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি । কিছু মনে করো না । জাস্ট কিউরিওসিটি বলতে পারো । আসলে না জিজ্ঞাসা করেও থাকতে পারছি না। „
আকাশ টিফিন কৌটটা খুলতে খুলতে বললো , “ আগে প্রশ্নটা তো শুনি । তারপর । „
“ তুমি এই কোম্পানির মালিক হয়ে , মানে ভবিষ্যতের মালিক হয়ে এই কাজ করছো ! ……
“ বুঝেছি । আসলে আমি একটু বেশি অহংকারী ছিলাম। টাকার অহংকার ছিল সেটা এখন বুঝতে পারি। মাসের শেষে নিজের হাতে যখন সাত হাজার টাকা পাই তখন বুঝি ….
গোধূলির আরও অবাক হওয়ার বাকি ছিল। এখন আকাশ যে সাত হাজার বেতনে কাজ করে সেটা শুনে চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এলো। ভুরু কপালে উঠে এলো , “ তুমি সাত হাজার বেতনে এখানে কাজ করো ! „
“ হ্যাঁ। তাই এখন কষ্টের উপার্জনটা বুঝি । „
গোধূলি আর কিছু বললো না। কিন্তু আকাশের কথা শুনে সে যে খুব ইমপ্রেস হয়েছে সেটা তার চোখে মুখে ফুটে উঠলো।
এতক্ষণে আকাশের টিফিন কৌটটা খুলে গেছে। আর তাতে মাছ ভাত আছে সেটাও গোধূলি দেখে ফেলেছে , “ তুমি এটা টিফিন করবে ? „
“ আমি মাছে ভাতে বাঙালি। দুপুরে ভাত না হলে চলে না। „ তারপর গোধূলির টিফিনে নুডলস দেখে বললো , “ এটা তো একদমই চলবে না । „
অনেক্ষণ ধরে আকাশের মনে একটা প্রশ্ন বিঁধছিল এখন সেটা বলে ফেললো , “ তুমি ইংলিশ মিডিয়ামের মেয়ে । লন্ডনে পড়াশোনা করেছো । কিন্তু তুমি ইংলিশ বলোই না এখন। ছোটবেলায় তো খুব বলতে । „
গোধূলি রুমালে হাসি চেপে বললো , “ ছোটবেলায় ছিলাম ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রী। তখন আলাদা কথা ছিল। লন্ডনে আমার মাসির মেয়ের সাথে একসাথে থাকতাম। ও বাংলা সাহিত্যের খুব বড়ো ভক্ত। বাংলা মিডিয়ামেই পড়তো বলে তখন কথা বলতাম না। ওখানে গিয়ে ওর সাথে থেকে বুঝতে পেরেছি কতো বড়ো ভুল করেছিলাম। এখন আমাকে বাংলা সাহিত্যের পোকা বলতে পারো । „
গোধূলির কথা শেষ হতেই দুজনেই হেসে উঠলো।
দুই দিন পর অফিস আওয়ার শেষে সবাই চলে যেতে লাগলো কিন্তু আকাশের বাবা আর সঞ্জয় গেল না। কিছুক্ষণ পর একটা মিটিং হবে । বাইরের একটা কোম্পানির দুইজন লোক এখন কলকাতা শহরে এসে পৌছেছে। তাই মিটিংটা এখনই করতে হবে।
গোধূলি আর আকাশের অফিসে থেকে কোন কাজ নেই তাই আকাশের বাবা বললেন , “ তোরা চলে যা । আমাদের মিটিং শেষ হতে হয়তো সময় লাগবে । „
গোধূলি বললো , “ আমি কিসে যাবো ? „
সঞ্জয় একটা ভালো সুযোগ পেয়ে গেল। সে বললো , “ আকাশ তোকে ড্রপ করে দেবে । তুই চলে যা । „
গোধূলিকে নিজের বাইকে ছেড়ে দিয়ে আসতে হবে শুনে আকাশ বিরক্ত হলো। সে বাবার দিকে তাকাতে শুভাশীষ বাবু একটা সম্মতি সূচক মাথা নেড়ে আকাশকে ছেড়ে আসতে বললেন।
তারপর দুজনেই নিচে নেমে এলো। পার্কিং থেকে বাইকটা বার করতে গিয়ে আকাশ দেখলো সুচিও তার নতুন স্কুটি বার করছে। দুজনের চোখাচোখি হলো। আকাশ সুচিকে দেখে মাথা নিচু করে বাইকে উঠে স্টার্ট দিয়ে দিল। গোধূলি আকাশের পিছনে বসতেই আকাশ বাইক চালিয়ে দিল।
এতদিনে সুচি গোধূলির পরিচয় পেয়ে গেছে। একসময় যার জন্য সে আকাশকে চড় মেরেছিল , যার উপর রেগে গিয়ে সঞ্জয়ের গাড়ির চাকার হাওয়া খুলে দিয়েছিল , সেই মেয়েই আজ সুচির বস। আকাশের বাইকে গোধূলিকে বসতে দেখে সুচি রাগে ফুসে উঠলো। আকাশের বাইকের ওই জায়গাটা তার যে নিজের। কেউ কিভাবে ওখানে বসতে পারে ! আর আকাশই ওকে বসতে দিচ্ছে এটা ভেবেই আকাশের উপর রাগ আরও বেড়ে গেল।
পরক্ষণেই সুচি ভাবলো , ‘ না , এ আমি কি ভাবছি ! ওর বাইকে যেই বসুক। আমার কিছু যায় আসে না। ,
এদিকে বাইক রাস্তায় নামিয়ে আকাশ ভাবতে লাগলো , ‘ ইসসস , কি ভাবছে ও এখন ! মনে হয় রেগে আছে । ,
পুরো রাস্তা সাবধানে বাইক চালিয়ে গোধূলির দিক নির্দেশ মতো যখন আকাশে সল্টলেকে গোধূলির বাড়ির সামনে এসে থামলো তখন গোধূলি বাইক থেকে নেমে বললো , “ আমি ভেবেছিলাম তুমি সুযোগ বুঝে বারবার ব্রেক মারবে। „ কথাটা বলেই গোধূলি হেসে উঠলো
গোধূলির কথা শুনে আকাশ অপ্রস্তুত হয়ে উঠলো। আকাশের হাবভাব দেখে গোধূলি বললো , “ আরে ! তুমি তো সিরিয়াস হয়ে গেলে । আমি মজা করছিলাম । „
এবার আকাশের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। গোধূলিকে bye বলে আকাশ বাড়ি চলে এলো।
এর কয়েক দিন পর বাড়ি ফেরার সময় আকাশকে বিদায় জানিয়ে গোধূলি বাবার গাড়িতে উঠে বসলো সঞ্জয় গাড়ি চালিয়ে কিছুদূর গিয়ে বললো , “ কেমন লাগলো ওকে ? „
সঞ্জয় তার মেয়ের সাথে খুব ফ্রি। বন্ধু বলা যায়। ছোটবেলা থেকেই একজন বাবার থেকে একজন বন্ধু হিসেবেই মেয়ের সাথে মেশার চেষ্টা করেছে সে। তাই প্রশ্নটা করে সঞ্জয় লাজুক হাসি হাসতে লাগলো।
বাবার দুষ্টুমির হাসি দেখে গোধূলিও হেসে বললো , “ মানে ! „
মুখের হাসিটা বজায় রেখেই সঞ্জয় বললো , “ সত্যিটা বল না । „
কিছু না বোঝার ভান করে গোধূলি জিজ্ঞাসা করলো , “ কি বলবো ? „
“ ওকে কেমন লাগলো ? „
“ কাকে ? „
“ আকাশকে। „
“ ভালোই। হ্যান্ডসাম । ম্যাচিউর। সেন্স অফ হিউমার একটু কম । „
“ তাহলে কিছু খামতি আছে বলছিস ! „
“ তুমি এইসব জিজ্ঞাসা করছো কেন বলোতো বাপি ? „
“ আমার মেয়ের কাকে পছন্দ হলো সেটাই জিজ্ঞাসা করছি । „
“ তুমিও না বাপি ! „
“ ওকে যদি ভালো লাগে তাহলে প্রোপজ করে দে। মেয়ে হয়ে প্রোপজ করবি লজ্জা লাগবে নাকি ! „
“ কি সব বলছো তুমি ! „
“ ওর গার্লফ্রেন্ড আছে নাকি যে প্রোপজ করা যাবে না ……
দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে গোধূলি বললো , “ না নেই । „
“ তুই কি করে বুঝলি ? „
“ ওকে দেখে এমনিই বোঝা যায়। সারাদিনে আন্টি বার কয়েক ফোন করে আর কেউ ফোন করে না। কেউ মেসেজও করে না । মানে কেউ নেই । „
“ আমার মেয়ে ইন্টেলিজেন্ট বলতে হয় । „
“ এতে মেধাবীর কিছু নেই। মেয়েরা এটা বুঝতে পারে । „
“ তাহলে প্রোপজ করে দে। সামনে তো ভ্যালেন্টাইন ডে। প্রথমেই রোজ ডে। একটা গোলাপ কিনে প্রোপজ কর । কতদিন আর একা থাকবি ? „
“ তুমিও না বাপি। সবসময় ওইসব ! „
“ শোন। তোর বয়সে আমি তোর মায়ের সাথে চুটিয়ে প্রেম করেছি। লজ্জা কিসের ! „
গোধূলি আর কথা বাড়ানো না। দেখতে দেখতে রোজ ডে চলে এলো। গোধূলি বাবার কথা ভুলেই গেছিল। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে যায়। ঠিক তখন সঞ্জয় একটা গোলাপ ফুলের তোড়া মেয়েকে দিয়ে বললো , “ এনে । „
গোধূলি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো , “ কি এটা ? „
“ গোলাপ। আকাশকে প্রোপজ করার জন্য । „
গলায় বিস্ময় ঝড়িয়ে গোধূলি বললো , “ বাপি তুমি সত্যি চাও আমি ওর সাথে রিলেশনে যাই ? „
“ আমি চাই তুই সুখে থাক । আর আকাশ খুব ভালো ছেলে। এরকম ছেলে আর পাবি না। এনে ধর । „
গোধূলি বাবার কথায় উৎসাহ পেল। এমন নয় যে সে আকাশকে পছন্দ করে না। আকাশের মতো কিউট , হাল্কা ভোলা ছেলে , তার উপর লম্বা চওড়া তার খুব পছন্দ। আর এতদিনে বাবাকে এসিস্ট করতে গিয়ে , একই অফিসে আকাশের সাথে কাজ করে ছেলেটাকে পছন্দও হয়েছে তার। তাই বাবার উৎসাহে আর নিজের মনের গভীরে লুকিয়ে রাখা একটা ভালোলাগাকে বাস্তবায়ীত করতে সে ফুলের তোড়া থেকে একটা বড়ো সুন্দর গোলাপ ফুল তুলে নিল। তারপর অফিস ভর্তি এমপ্লয়ির চোখের সামনে দিয়ে আকাশের দিকে এগিয়ে গেল।
ঠিক সেই সময় একটা ফাইল দিতে সুচিও উপরে উঠে এলো। ফাইলটা দিয়ে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ দুটোকে জুড়িয়ে চলে যাওয়ার সময় দেখলো গোধূলি আকাশের দিকে এগিয়ে আসছে।
গোধূলি এগিয়ে এসে অফিস ভর্তি কর্মচারীদের মধ্যে আকাশকে গোলাপ ফুল দিয়ে বললো , “ happy rose day । „
কথাটা শুনে সুচির পা থেকে মাটি সরে গেল। একদিন এটা হওয়ারই ছিল। তারজন্য সুচি মানসিকভাবে প্রস্তুতও ছিল। কিন্তু এখন শত প্রস্তুতি সত্ত্বেও সুচির হৃদয়টা টুকরো টুকরো হয়ে গেল। হৃদয় ভাঙার যন্ত্রণা চোখের জল হয়ে দুই গাল ভাসিয়ে দিতে লাগলো।
গোলাপটা নিয়ে আকাশ বললো , “ থ্যাঙ্ক ইউ । „
কথাটা শুনেই সুচির মনে হলো কেউ যেন তার বুকে চাবুক মারলো। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে নিয়ে দৌড়ে সিড়ি দিয়ে নিজের ফ্লোরে চলে এলো।
তারপর কোনরকমে কাঁপা হাতে নিজের ব্যাগ আর হেলমেটটা নিয়ে লিফ্টে চলে এলো। এখন সে কি করছে , তার মন কি চাইছে সেটা সুচি বুঝতে পারছে না। লিফ্টে ঢুকে বারবার গ্রাউন্ড ফ্লোরের বোতাম টিপতে লাগলো। লিফ্ট গ্রাউন্ড ফ্লোরে পৌছতেই মাথায় হেলমেটটা গলিয়ে সুচি নিজের স্কুটি চালিয়ে রাস্তায় নেমে এলো । রাস্তায় স্কুটিটা নামতেই সুচির আর কন্ট্রোল রইলো না। চোখের জলে চোখটা মাঝে মাঝেই ঝাপসা হয়ে আসছে। চোখের পাতা বারবার উপর নীচে করে চোখ থেকে জল বার করতে হচ্ছে। দ্রুতগতিতে স্কুটি চালানোর জন্য চোখের জল হাওয়ায় ভেসে চকচক করে উঠছে। কিছুদূর যাওয়ার পর পাশে একটা বাইক এসে এক মধ্য বয়সী ভদ্রলোক বললো , “ ও দিদি ! আস্তে চালান । এক্ষুণি তো আমার সাথে ধাক্কা লাগতো ! „
লোকটার কথায় সুচি স্কুটিটাকে আস্তে চালাতে শুরু করলো । সোসাইটিতে ঢুকে কোনওরকমে স্কুটিটাকে পার্ক করে দৌড়তে দৌড়তে সিড়ি ভেঙে উপরে উঠে এলো। ফ্ল্যাটের দরজা কোনো কারনে ভেজানো ছিল। দরজা ঢেলে ঢুকে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। সাইড ব্যাগটাকে খাটের একদিকে ছুড়ে দিয়ে খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগলো।
সুচেতা দেবী মেয়েকে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকতে দেখেছিলেন। তিনি সুচির ঘরে ঢুকে সুচির পাশে বসে জিজ্ঞাসা করলেন , “ কি হলো ? কাঁদছিস কেন ? আর এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি ? „
কান্না ভেজা গলায় সুচি বললো , “ তুমি যাও মা । আমাকে একা থাকতে দাও । „
“ আমাকে বল কি হয়েছে । „
সুচি বিরক্ত হয়ে জোড় গলায় বললো , “ বললাম তো একা থাকতে দাও । „
সুচির মার গলায় মমতা ঝড়ে পড়লো , “ মাকে বল কি হয়েছে । „
সুচি বিরক্ত হয়ে উঠে , “ বললাম তো যাও । „ বলে মাকে ঢেলে বাইরে বার করে দিল। দরজায় ছিটকিনি দিয়ে , দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে দুই হাটুর মাঝে মুখ গুজে কাঁদতে লাগলো। যখন চোখে আর জল অবশিষ্ট রইলো না তখন মুখ তুলে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হাতের তালুতে দুই গালে লেগে থাকা চোখের জল মুছে নিল।
চোখের জল মুছতে মুছতে দেওয়ালে টাঙানো একটা ফ্রেম করা ফটোর উপর সুচির চোখ পড়লো । ফটোটা দিম্মা আর সুচির। সুচির দশ বছর বয়সে প্রথমবার স্টেজে নাচার পরের মুহুর্ত। ফটোতে সুচি তার সেই নীল শাড়ি পড়ে আছে। হাতে প্রথম পুরস্কারের ট্রফি। আর পাশে দিম্মা একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছে।
ফটোটা আকাশ তুলে দিয়েছিল। আর এই শাড়িটা আকাশ লুকিয়ে রেখে দিয়েছিল। সেইসব সুচির মনে পড়ে গেলে সে দেওয়াল থেকে ফটোটা নামিয়ে আনলো। হাত দিয়ে ফটোর উপর পড়ে থাকা ধুলো মুছে নিয়ে দিম্মার কথার সূত্র ধরে সুচি বললো , “ তুমি আমাকে ওর দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলে। আমি তোমার দায়িত্ব রাখতে পারলাম না দিম্মা। ও আমার থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। আমাকে দিয়ে যাওয়া তোমার শেষ কাজ আমি রাখতে পারলাম না দিম্মা । আমাকে ক্ষমা করে দাও দিম্মা। আমাকে ক্ষমা করে দাও। „ বলে ফটোটা নিজের বুকে চেপে ধরলো ।
কিছুক্ষণ ফটোটা নিজের বুকে চেপে ধরে থেকে রহমত চাচার বলা কথাটাও সুচির মনে পড়ে গেল। রহমত চাচা তাকে আকাশের খেয়াল রাখতে বলেছিল। দাদুর কথার সূত্র ধরে সুচি বললো , “ তুমি আমাকে আকাশের খেয়াল রাখতে বলেছিলে দাদু । তার বদলে আমি ওকে মেরেছি। গালাগালি দিয়েছি , অত্যাচার করেছি। আমি তোমাদের কারোর কথা রাখতে পারিনি দিম্মা। আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও দাদু দিম্মা । „
কথাটা বলে সুচি ফটোটা বুকে চেপে ধরে খাটে চুপচাপ শুয়ে রইলো।
সাতটার কিছু আগে সুচির বাবা অফিস থেকে ফিরলেন। এসে দেখলেন সুচির মা চোখের জল ফেলছেন। স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন , “ কাঁদছো কেন ? কি হয়েছে ? „
স্বামীর চিন্তার তোয়াক্কা না করে সুচির মা বললেন , “ কিছু না । „
সুচির বাবার গলায় এবার রাগ দেখা দিল , “ কি হয়েছে বলবে তো ? „
“ বললাম তো কিছু না। „ রাগী স্বরে কথাটা বলে স্বামীকে চুপ করিয়ে দিলেন।
সেই যে সুচি দরজায় ছিটকিনি দিল আর খুললো না। খাওয়ার সময় সুচির মা বেশ কয়েকবার ডাকলেন কিন্তু সুচি ঘর থেকে বার হলো না। সমরেশ বাবু পুরো ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও এটা বুঝলেন যে সুচি কাঁদছে। আর সুচির কান্নার একটাই কারন। সেটা হলো আকাশ। নামটা মাথাতে আসতে তিনিও চুপ করে গেলেন।
রোজ রাতে সুচি দিদিকে ফোন করে ঘুমায়। আজ সুচি ফোন করলো না। সুমি নিজে ফোন করলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা ধরলো সুচি। ফোন ধরতেই সুমি বললো , “ কি হয়েছে বলতো ? মা ফোন করে কান্নাকাটি করছে । খাচ্ছিস না কিছু , বলছিস ও না কিছু ! „
এতক্ষণ পর একজনকে মন খুলে কথা বলার সুযোগ পেয়ে সুচি ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সব বলে দিল। সব শুনে সুমি রাগি গলায় বললো , “ আমার এখন তোর উপর রাগ হচ্ছে । এতো বোঝানোর পরেও তুই এখনও কাঁদছিস। বললাম পলাশের সাথে রিলেশনে যা । আকাশ নিজের ভালোটা বুঝে নিচ্ছে তুইও বুঝতে শেখ , না হলে আরও চোখের জল ফেলতে হবে তোকে । „
দিদির রাগী স্বরে সব শুনে সুচি চোখ মুছে নিল। ওদিকে সুমি বলে চলেছে , “ নিজে তো কষ্ট পাচ্ছিস মাকেও কাঁদাচ্ছিস। এবার যদি তুই কিছু না করিস তাহলে আমি মায়ের সাথে কথা বলে তোর বিয়ের জন্য পাত্র দেখবো। আমিও আর পারছি না রোজ রোজ তোর আর মায়ের চোখের জল দেখতে ! „ বলেই সুমি ফোনটা কেটে দিল ।
দিদির কথা শুনে ভারাক্রান্ত মনে সুচি বিছানায় শুয়ে রইলো। মাথা কাজ করছে না তার। শেষ রাতের দিকে চোখটা ঘুমে বুজে এলো।
এদিকে আকাশ অফিস থেকে বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে ঢুকে চুপচাপ খাটে শুয়ে রইলো। কোনও রকমে ডিনার করে এসে খাটে শুয়ে রইলো। সারা রাত গোধূলির প্রোপজের কথাটা মাথায় ঘোরার ফলে ভালো করে ঘুম হলো না । এখন মাকে রাজি করাতেই হবে এটাই সারারাত ভাবতে লাগলো।
পরের দিন সকালে জানালার লোহার গ্রিলে বসে থাকা জোড়া শালিক পাখির কিচিরমিচির শব্দে সুচির ঘুম ভাঙলো। আধবোজা চোখে কালকের ঘটনা মনে করলো। বুক চাইছে আবার কাঁদতে কিন্তু চোখ নিজের জল বার করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। বুকের ব্যাথাতে চোখ আর জল বার করে বুককে সাহায্য করলো না। ভারী বুক নিয়ে বাথরুমে গিয়ে মুখে জলের ঝাপটা দিলো সুচি। তারপর স্নান করে গতকালের বাসি জামা কাপড় চেঞ্জ করলো।
ঘরে এসে ফোন খুলে দেখলো পলাশের একটা গুড মর্নিং মেসেজ। সুচি দেখলো কিন্তু উত্তর দিল না। কোন কিছু শুভ নেই এই সকালে। সুচি মেসেজ সিন করেছে দেখে পলাশ লিখলো , “ আজকে কি ব্যাস্ত ? অফিস যাবে ? „
সুচি এবার সভ্যতা বজায় রাখতে লিখলো — আজ অফিস যাবো না। মুড নেই ।
পলাশ — তাহলে বিকালে একটা জায়গায় চলো। মুড ভালো হয়ে যাবে ।
সুচি — Date !
পলাশ —- Kind of
সুচি — Ok
আগের দিন অফিসে যা হলো তারজন্য আকাশের এখনও মুড খারাপ। তাই সেও সুচির মতো অফিস কামাই করলো। রাতে অনেক ভেবে বার করেছে যে প্রথমে মাকে রাজি করাতে হবে। তারপর মাকে নিজের দলে নিয়ে বাবাকে রাজি করাতে হবে।
তাই বাবা অফিস যাওয়ার সময় যখন জিজ্ঞাসা করলো , “ আজ অফিস যাবি না ? „
তখন আকাশ বললো ,“ না , আজ ভালো লাগছে না। „
“ মাইনে কাটা যাবে কিন্তু । „
এর উত্তরে আকাশ কিছু বললো না। বাবা চলে গেলে সে রান্নাঘরে এঁটো বাসন ধুতে থাকা মায়ের হাত ধরে বললো , “ তোমার সাথে কথা আছে। এসো । „
আকাশের মা খুব অবাক হলেন , “ কি কথা ? „
“ এসো না ! বলছি। „ বলে মায়ের হাত ধরে এনে সোফায় বসালো । স্নেহা দেবী ছেলের কর্মকাণ্ড দেখে এতো অবাক হলেন যে তার মুখ দিয়ে কিছুই বার হলো না।
মাকে সোফায় বসিয়ে নিজে মায়ের পায়ের কাছে মেঝেতে বসে আদরের সুরে বললো , “ তোমার সাথে কিছু কথা ছিল । „
“ বল কি কথা ? „
“ তুমি প্লিজ রেগে যেও না । „
স্নেহা দেবী ভাবলেন ছেলে আবার নতুন কোন বাইক কিনবে হয়তো , “ তুই আবার কোন নতুন বাইক কিনবি ? „
“ বাইক টাইক না । আমি সুচির ব্যাপারে কথা বলছি । „
সুচির নাম শুনেই স্নেহা দেবী থম মেরে গেলেন। ওদিকে আকাশ মায়ের কোলে মাথা রেখে বলে চলেছে , “ প্লিজ মা , তুমি জানো আমি কি বলছি। প্লিজ রাজি হয়ে যাও । „
স্নেহা দেবী ভালো ভাবেই বুঝতে পারছেন তার ছেলে কি বলতে চাইছে কিন্তু তিনি ছেলের মুখ থেকে শুনতে চান , “ আমি কিছু বুঝতে পারছি না । কি বলছিস তুই ? „
“ প্লিজ মা , এমন করো না । তোমার দুটি পায়ে পরি। তুমি জানো ও আমাকে ভালোবাসে , আমিও ওকে ভালোবাসি। প্লিজ তুমি রাজি হয়ে যাও । „
ছেলের এইভাবে নিজের ভালোবাসা ব্যাক্ত করতে দেখে মায়ের মন গলে গেল , “ দিদি তো আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আর কথা বলে না আমাদের সাথে। আমি কি করবো বল ! „
মা রাজি হচ্ছে দেখে আকাশের মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো , “ তুমি শুধু বাবাকে রাজি করাও । জেঠা জেঠিকে আমরা সবাই মিলে রাজি করাবো । „
ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে একটা চুমু খেয়ে স্নেহা দেবী ভাবলেন , ‘ ছেলেটা এখনও বাচ্চাই রয়ে গেছে। এখনও সেই আগের মতো আবদার করছে। যেটা সম্ভব না সেটা চাইছে । কি সুন্দর অকপটে নিজের ভালোবাসার কথা বলছে । ‚ মনে মনে ছেলেকে আশীর্বাদ করলেন তিনি , ‘ এরকমই সহজ সরল থাক সারাজীবন। , ছেলেকে প্রান ভরে আশীর্বাদ করে বললেন , “ ঠিক আছে । তোর বাবার সাথে রাতে কথা বলবো । „
মা রাজি হয়েছে দেখেই আকাশের চোখে জল চলে এলো। এবার একটা আশার আলো দেখতে পেল সে । মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই সে মাকে জড়িয়ে ধরলো।
বিকালে হতেই সুচি মেকআপ করতে বসলো। কার জন্য সাজলো সেটা সুচি জানে না। নতুন জীবন শুরু করতে চলেছে সে জন্য ? নাকি আকাশের উপর রাগের জন্য সেটা সুচি জানে না। মেকআপ করে নিজের পছন্দের ড্রেস কোড কুর্তি আর জিন্স পড়ে স্কুটি নিয়ে বার হলো ।
ত্রিশ মিনিট স্কুটি চালিয়ে পলাশের দেওয়া ঠিকানা ধর্মতলার একটা হোটেল কাম রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়ালো। স্কুটিটাকে পার্ক করে ভিতরে ঢুকে দেখলো চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা টেবিলে বেশ কয়েকজন খাচ্ছে। এখন বিকাল তাই টিফিন করছে সবাই । এদের মধ্যে থেকেই একটা চেয়ার থেকে উঠে পলাশ হাত নাড়লো । সুচি মিষ্টি মুখে পলাশের দিকে এগিয়ে গেল। টেবিলটার সামনে যেতেই পলাশ বললো , “ আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো ! „
একটা চেয়ারে বসতে বসতে সুচি বললো , “ না তেমন না। তবে এখন ট্রাফিক বাড়ছে তাই একটু দেরি হলো । „
“ কি খাবে বলো ? „
“ তুমি খাওয়াবে ? „
“ অবশ্যই আমি খাওয়াবো। আজকের ডিনার আমার তরফ থেকে। ডিনার না বলে এটাকে টিফিন বলতে পারো। যদি তুমি চাও তাহলে রাতের ডিনারও করে যেতে পারো । „
“ না , না। রাতের খাবার বাবা মার সাথে না খেলে চিন্তা করবে । „
“ As you wish। কি খাবে বলো ? „
“ এখন হাল্কা কিছু খেলে ভালো । „
“ নুডলস অর্ডার দিই ? „
“ দাও । „
পলাশ একজন ওয়েটার কে ডেকে দুই প্লেট হাক্কা নুডলস অর্ডার দিয়ে দিল। নুডলস এলে দুজনে খাওয়া শুরু করলো। খাওয়ার মাঝে পলাশ না না কথার মাঝে বললো , “ তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে । „
“ Thank you । „
সুচি কথাটা বলতেই পলাশ পকেট থেকে একটা ছোট বাক্স বার করলো। সোনার দোকানে আংটি বিক্রি করার সময় যেমন বাক্স দেওয়া হয় এটা ঠিক তেমন । বাক্সটা বার করেই মেঝেতে একটা হাটু গেড়ে বসে আংটির কৌটোটা খুলে বললো , “ will you be my valentine ? „
পলাশের এইরূপ আচরণ আসে পাশে বসে থাকা সবার দৃষ্টি কাড়লো । সবাই এবার সুচির উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো , “ say yes , say yes । woooow । „
পলাশের এইভাবে প্রোপজ করতে দেখে সুচি ভাবলো , ‘ দিদিতো এটাই চেয়েছিল যে সে এই ছেলেটার সাথে রিলেশনে যাক। , তারপর সুচির কি হলো সুচি নিজেই জানে না। কেন সে উঠে দাড়ালো সেটা সে জানে না। কেন সে হাত বাড়িয়ে দিল সেটাও জানে না। সুচি হাত বাড়িয়ে দিতেই পলাশ তার অনামিকাতে সোনার আংটিটা বসিয়ে দিল। তারপর আশেপাশের সবাই হাততালি দিয়ে শুভেচ্ছা দিল।
হঠাৎ করে কি হলো সেটা সুচি বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে টেবিলে বসে পড়লো। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন সবাই সুখী শুধু সুচি ছাড়া। সুচি কিসে সুখী হবে সেটা কারোর যায় আসে না। বাকি সবাই খুশী হলেই হলো। সুচি টেবিলে বসলে পলাশও টেবিলে বসে পড়লো , “ তুমি জানো না আজ আমি কতো খুশি। ….
পলাশের কথা আর সুচির কানে যাচ্ছে না। এখন তার মাথায় চলছে দিদির দেওয়া হুমকির কথা। আকাশকে গোধূলির দেওয়া গোলাপের কথা। আর তারপর আকাশের thank you বলা।
খাওয়া হয়ে গেলে পলাশ বললো , “ গঙ্গা পাড়ে গিয়ে বসবে ? খুব মিঠে হাওয়া দেয় ওখানে। „
সুচি সম্মতি সূচক মাথা নাড়লে পলাশ বললো , “ তার আগে তোমার জন্য আরও একটা সারপ্রাইজ আছে। উপরের ঘরে আছে। চলো । „
সুচি হাত ধুয়ে , মুখে জল ছিটিয়ে এসে সিড়ি দিয়ে পলাশের পাশে পাশে হেটে উপরে উঠে এলো । একটা করিডোর ঘুরে আর একটাতে আসতেই সুচি বুঝতে পারলো পলাশের অভিসন্ধি। বুঝতে পেরেই আকাশের উপর রাগ আরও বেড়ে গেল।
কিছুক্ষণ পরেই একটা ঘরের সামনে এসে পলাশ দরজায় চাবি ঢুকিয়ে দরজা খুলে বললো , “ এসো । „
সুচি ঘরে ঢুকলে পলাশও ঘরে ঢুকে এলো। দরজা না লাগিয়ে ভেজানো অবস্থাতেই পলাশ সুচিকে টেনে তার ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দিল।
কতক্ষণ ওইভাবে ছিল সেটা সুচি জানে না। কিন্তু পলাশের চুলে হাত দিতেই সুচির মনে হলো এ চুল অন্য কারোর। নিজের ঠোঁটের ভিতর পলাশের ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে সুচির মনে হলো , ‘ এ ঠোঁট পরপুরুষের। , সঙ্গে সঙ্গে পলাশকে ঠেলে সরিয়ে সুচি বললো , “ সরি পলাশ । এ আমি পারবো না । „
কথাটা বলে সুচি হাতের আংটিটা খুলতে লাগলো। পলাশ বড়ো বড়ো চোখ বার করে সুচির আংটি খোলা দেখতে লাগলো। আংটি খুলে পলাশের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সুচি বললো , “ আমায় ক্ষমা করো তুমি । আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। „
পলাশের মুখে শয়তানের হাসি ফুটে উঠলো , “ সে তুই অন্য কাউকে ভালোবাস । তাতে আমার কোন সমস্যা নেই । শুধু আজ রাতটা আমার বিছানা গরম করে যা । „
পলাশের এ হেন কথা শুনে সুচির চোখ দুটো রাগে জ্বলে উঠলো , “ কি বলছো এসব ! „
“ ঠিক বলছি । তোর জন্য অনেক খরচা করেছি। সব টাকা অসুল করে ছাড়বো । „ বলে সুচির হাতটা ধরে টেনে বিছানায় ফেলতে গেল ।
সুচির চড় খেয়ে শুধু একজনই নিজের হুশ ধরে রাখতে পারে। আর সেই একজনের নাম পলাশ নয়। তাই পলাশও পারলো না সুচির চড় সহ্য করতে। ঠাসসসসস করে একটা চড় পলাশের গালের উপর পড়তেই তার চোখে অন্ধকার হয়ে এলো । কিছু বোঝার আগে সুচি বললো , “ লম্পট , আগে মেয়েদের সম্মান করতে শেখ । „ বলে হাতের আংটিটা একদিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে গেল ।
চড়টা সয়ে এলে পলাশ গালে হাত বুলিয়ে দেখলো এখনও গরম আছে । রাগে বিড়বিড় করতে লাগলো সে , “ তোর রুপের এতোই অহংকার ! তুই আমাকে চড় মারলি ! „
সুচি এর কিছুই শুনতে পেলো না কারন সে ততক্ষণে নিচে নেমে এসেছে। নিচে নেমে স্কুটি চালিয়ে রাস্তায় নেমে এলো সে। পলাশের করা অপমানে এখনও মাথা রাগে ফুটছে। কোনও রকমে স্কুটি চালিয়ে সোসাইটিতে ফিরে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়লো। বাথরুমে এসে চোখে মুখে জল ছিটিয়ে এসে নিজের ঘরে এলো।
নিজের ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে মোবাইলে নতুন ফ্ল্যাট দেখতে বসলো। কোন ব্যাঙ্ক কত সুদে হোম লোন দিচ্ছে সেটা দেখতে লাগলো। সবকিছু দেখতে দেখতে কখন খাওয়ার সময় এলো সেটা সুচি বুঝতে পারলো না। টেবিলে এসে চুপচাপ নিজের খাওয়া হয়ে গেলে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো , “ তুমি বলেছিলে না যে বাড়ি বদলাবে ! আমি একটা 2bhk দেখেছি । আমাদের তিনজনের হয়ে যাবে । হোম লোনের জন্য এপ্লাই করবো কি না বলো ? „
সুচির বাবা মেয়ের কথা শুনে থম মেরে গেলেন। কি বলবেন ভেবে পেলেন না। সুচি বললো , “ কি ভাবছো । „
সুচির বাবা কোন রকমে বললেন , “ হঠাৎ এইসব ! „
“ আমার এখানে থাকতে আর বিন্দুমাত্র ভালো লাগছে না। তুমি ভেবে দেখো । „ বলে সুচি টেবিল থেকে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল।
সুচি চলে যেতেই সুচির মায়ের চোখ দুই গালে ভেসে গেল , “ আমি আর পারছি না ওকে এইভাবে দেখতে। „ কথাটা বলতেই একফোটা চোখের জল তার খাবার বাসনে তরকারি মাখা ভাতের উপর পড়লো ।
সমরেশ বাবু আগেই থম মেরে গেছিলেন। এখন বোবা হয়ে গেলেন। এই কয় বছরে তিনিও খুব কষ্ট পেয়েছেন। মেয়ের গালের যে দুটো টোল তার রুপের মাধুর্য ছিল ! সেই দুটো টোল এখন কবরের গর্তের মতো মৃত মনে হয়। এখন তিনি আর মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারেন না। বারবার নিজেকে বলেছেন , ‘ এ আমি চাই নি। এরকমটা আমি কখনোই চাই নি । ,
কোনোরকমে খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে তিনি ফ্ল্যাটের বাইরে যেতে লাগলেন। স্বামীকে দেখে সুচির মা চোখের জল মুছে জিজ্ঞাসা করলেন , “ কোথায় যাচ্ছো এতো রাতে ? „
“ আকাশের বাবার কাছে । „
এদিকে আকাশ তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে ঘরে এসে শুয়েছে । মা বলেছিল খাবার পরেই কথাটা পাড়বেন। সেই আশাতেই সে অপেক্ষা করছে। ডিনার করার পর সবকিছু গোছাতে গোছাতে ছেলের কথা রাখতে স্নেহা দেবী স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন , “ বলছি…..
আকাশের মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই ডিং ডং শব্দ করে ঘরের ডোরবেল বেজে উঠলো ।
Update 5
খাওয়া শেষ করে , এঁটো হাত ধুয়ে একটা তোয়ালেতে হাত মুছছিলেন আকাশের বাবা। আকাশের মায়ের “ বলছি „ কথাতে তিনি ঘুরে সহধর্মিণীর দিকে তাকালেন। ঠিক সেই সময় ডোরবেল বেজে উঠতে তিনি খুব অবাক হলেন , “ এত রাতে কে এলো ! দেখো তো । „
দরজার ওই পাড়ে দাঁড়িয়ে সুচির মা জিজ্ঞাসা করলেন , “ এত রাতে কি কথা বলবে তুমি ? „
সুচির বাবা গম্ভীর স্বরে বললেন , “ সুচি আর আকাশের বিয়ের কথা বলবো । „
সুচির মাকে যদি হঠাৎ আলাদিনের জিন এসে তিনটে ইচ্ছার কথা জিজ্ঞাসা করতো তাহলেও মনে হয় তিনি এতোটা অবাক হতেন না যতোটা আকাশ আর সুচির বিয়ের কথা শুনে হলেন। কথাটা শুনে এতক্ষণ চোখ দিয়ে নদীর জোয়ারের মতো বেরিয়ে আসা জলে হঠাৎ ভাটা পড়লো। তিনি নিজেকে সামলে যে প্রশ্নটা করা দরকার সেটাই করলেন , “ যদি রাজি না হয় ? „
নিজের স্বরে গম্ভীর ভাবটা বজায় রেখেই সুচির বাবা বললেন , “ তাহলে হাতে পায়ে ধরবো….
সুচির বাবার কথা শেষ হতেই আকাশের মা দরজা খুলে দিলেন । এতো রাতে সুচির মা বাবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি খুব অবাক হলেন , “ তোমরা ! „
সুচির বাবা বললেন “ আমি….
আকাশের মা সুচির বাবার কথা শেষ হওয়ার আগেই , “ ভেতরে এসো। „ বলে দরজা থেকে সরে গেলেন ।
সুচির মা বাবা ঘরে ঢুকে এলে আকাশের বাবা তোয়ালেটা আবার যথাস্থানে রেখে জিজ্ঞাসা করলেন , “ কিছু বলবে ? „
সুচির বাবা খুব জরুরি কথা বলতে এসছেন এমন ভাব করে বললেন , “ কিছু কথা ছিল । „
এই রাত দুপুরে কি এমন জরুরি কথা সেটা ভেবেই আকাশের বাবা গম্ভীর হয়ে গেলেন। সোফা দেখিয়ে বললেন , “ বসো । „
আকাশ অন্ধকার ঘরে খাটে শুয়ে অপেক্ষা করছিল কখন তার মা বাবাকে সুচি আর তার সম্পর্কে বলবে। হঠাৎ ডোরবেল বেজে ওঠায় কৌতুহলবশত খাট থেকে উঠে এসে দরজা হাল্কা ফাক করে সে দেখলো যে সুচির মা বাবা এসছে। এখন কেন জেঠু এলো সেটা জানার জন্য সে অন্ধকার ঘরে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
সুচির মা বাবা দুজনেই একটা বড়ো সোফা দখল করে পাশাপাশি বসলেন। আকাশের মা পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন কথোপকথন শুনবেন বলে। আকাশের বাবা একটা সোফা দখল করে বসে জিজ্ঞাসা করলেন , “ বলো কি বলবে । „
কিছুক্ষণ ইতস্তত করে একটা বড়ো প্রশ্বাস নিয়ে সুচির বাবা বললেন , “ আমি আমার ছোট মেয়ের ব্যাপারে কথা বলতে এসছি । „
সুচি তারই কোম্পানিতে কাজ করে। সুচির বাবার কথা শুনে আকাশের বাবার মনে হলো হয়তো কোন এমপ্লয়ি সুচির সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে তাই সুচির বাবা অভিযোগ করতে এসছে । তাই একটু ঘাবড়ে গিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন , “ কোন ব্যাপারে ? মানে অফিসে যদি কেউ ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করে তাহলে বলতে পারো । আমি তাকে পুলিশে দেবো। „
সুচির বাবা বুঝলেন যে আকাশের বাবা ভুল বুঝছেন। তাই তিনি তাকে আশ্বস্ত করার জন্য বললেন , “ না , না , তেমন কিছু না । „
“ তাহলে ? „
বেশি ভনিতা না করেই আসল কথাটা বলে ফেললেন সুচির বাবা , “ আকাশ আর সুচির ব্যপারে কথা বলছি। „
এতোটা শুনেই আকাশের বাবার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো । এটা যে একদিন হবে সেটা তিনি অষ্টমীর রাতেই হাল্কা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। নিজের দূরদর্শিতার কথা ভেবে এখন নিজের উপর গর্ব হচ্ছে। আর তাই মুখে ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। সুচির বাবা এটাকে ব্যাঙ্গের হাসি ভেবে নিয়ে মুষড়ে পড়লেন।
সুচির বাবা এখানে আসার আগে ভেবেছিলেন যে হয়তো তিনি আকাশের বাবাকে বোঝাতে পারবেন। কিন্তু আকাশের বাবার হাসি সেটাকে মিথ্যা প্রমাণ করছে। তাই তার গলায় অনুরোধের সুর দেখা দিল , “ দেখো , এক মূহুর্তের জন্য আমরা কি নিজেদের অতীতের সবকিছু ভুলে আমাদের সন্তানদের কষ্ট ভাবতে পারি না…..
সুচির বাবা মিইয়ে যাওয়া গলা দেখে আকাশের বাবার খুব হাসি পেল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলেন। কিন্তু চোখে মুখে আনন্দ হাসির উচ্ছাস আরও স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠলো। এটা দেখে সুচির বাবা আরও মিইয়ে গেলেন । যে আত্মবিশ্বাসের সাথে তিনি এখানে এসে কথা বলতে শুরু করেছিলেন তা ক্রমশ হ্রাস পেতে লাগলো , “ চার বছর আগে অষ্টমীর রাতে কি হয়েছিল সেটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু তুমি এটা জানো না যে আমার মেয়ে কতোটা কষ্টে আছে। আমি দেখতে পারছি না ওর কষ্ট …..
সুচির বাবার গলার স্বর শুনে আকাশের বাবার মনে হলো এবার শুধু পায়ে ধরাটাই বাকি । কথাটা মনে আসতেই ফিক করে হেসে ফেললেন তিনি। এই হাসি দেখে সুচির মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। এতক্ষণ আকাশের মা দুজনেরই কথা শুনছিলেন আর সবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন। স্বামীর এমন ব্যাঙ্গ তার চোখ এড়ায় নি। এখন আকাশের বাবার হাসি দেখে স্নেহা দেবীর মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা হলো। মনে হলো যেন মাটি ফেটে যাক আর এই ফ্লাটটা তার ভিতরে প্রবেশ করুক।
এই হাসি দেখে সত্যি সত্যি সুচির বাবা হাত জোড় করলেন , “ প্লিজ তোমার পায়ে পড়ি। আমার মেয়েটা খুব কষ্ট পাচ্ছে। আমি তাকাতে পারছি না ওর মুখের দিকে। ওরা একসাথে বড়ো হয়েছে । হঠাৎ করে আলাদা হয়ে যাওয়ায় আমার মেয়ে খুব কষ্ট পেয়েছে। প্লিজ তুমি ভেবে দেখো ……
এতোটা শুনে আকাশের বাবা আর নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলেন না। হো হো হো করে অট্টহাসি হেসে ঘর কাঁপিয়ে দিলেন। হাসতে হাসতে সোফা থেকে উঠে ঘরে পায়চারি করতে লাগলেন।
এই অট্টহাস্য শুনে আকাশের মার মাথা কুটে মরতে ইচ্ছা হচ্ছিল। একজন তার মেয়ের কষ্ট দেখতে না পেরে এখানে এসে হাত জোড় করে কিছু অনুরোধ করছে আর তারই স্বামী সেই অনুরোধ দেখে অট্টহাস্য করছে। এরকম অপমান আকাশের মা কখনো হয়েছেন কি না সেটা জানা নেই। সুচির মা আকাশের বাবার অট্টহাস্য দেখে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন। চোখের জল বাঁধ মানছে না তার ।
আকাশ ঘরের মধ্যে থেকেই জেঠুর কথা শুনে আনন্দিত হচ্ছিল। একটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছিল। এখন সেই আলো নিভে গিয়ে সে অন্ধকার দেখতে শুরু করলো। সুচির বাবা ভাবলেন আর কিছু বলার নেই। এতো অপমানে রাতে তার ঘুম হবে না। তাই নিরুপায় হয়ে অপমানিত মন নিয়ে সোফা থেকে উঠে ঘরের বাইরে চলে যেতে লাগলেন। সুচির বাবা উঠে গেলে সুচির মাও স্বামীর পিছন নিলেন।
আকাশের মা সুচির বাবার মুখ দেখে থাকতে না পেরে আকাশের বাবাকে বললেন , “ তুমি কি পাগল হয়ে গেলে ? „
সুচির বাবা দরজা দিয়ে প্রায় বেরিয়ে গেছিলেন তখন হঠাৎ আকাশের বাবার অট্টহাস্য বন্ধ হয়ে গেল । গুরুগম্ভীর আওয়াজ হলো ঘরের মধ্যে , “ দাঁড়া । „
সুচির বাবা চৌকাঠের বাইরে পা ফেলতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ আকাশের বাবার দাঁড়া বলাতে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। ওদিকে আকাশের বাবা বলে চললেন , “ আজ যখন এসছিস তখন সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যা । „
আকাশের মা তার স্বামীর কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। সুচির বাবার সাথে তুই তোকারি করে কথা বলতে তিনি কখনো শোনেননি। আজ হঠাৎ এইসব শুনে তিনি বুঝতে পারলেন না যে কি হচ্ছে ? এদিকে আকাশ আর সুচির মায়েরও একই অবস্থা। তারাও কিছু ভেবে পাচ্ছে না।
সুচির বাবা এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বজ্রকঠিন মুখ করে জিজ্ঞাসু মনে দাঁড়িয়ে রইলেন। আকাশের বাবা সুচির বাবার দিকে দুই পা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন , “ তুই কি বললি ? তোর মেয়ে কষ্ট পাচ্ছে ! আর আমার ছেলের কষ্টের কথাটা তো একবারও বললি না ! „
সুচির বাবা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। আকাশের বাবা কোন উত্তর না পেয়ে বললেন , “ চুপ করে আছিস কেন ? বল। উত্তর দে। „ তারপর সুর করে বললেন , “ ওওও , বলবি কি করে ? তুই তো কখনো অপরের কষ্ট দেখতেই পাস না। সবসময় নিজের কষ্টটা বুঝিস। „ আকাশের বাবা আরো দু পা এগিয়ে গিয়ে সুচির বাবার বুকে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে বললেন , “ তুই যদি অন্যের কষ্ট বুঝতিস তাহলে মাকে শেষ জীবনে চোখে জল নিয়ে মরতে হতো না । „
এবার আর সুচির বাবা চুপ থাকতে পারলেন না , “ ছোটমা যদি কষ্ট পেয়ে থাকে তাহলে তার কারন শুধুমাত্র তুই আর তোর অহংকারী বাবা । „
“ হ্যাঁ আমি মানছি বাবার অহংকারের জন্য ঘরে অশান্তি হতো। মা অনেক কান্নাকাটি করতো। কিন্তু তুই মাকে যতোটা কাঁদিয়েছিস ততোটা আর কেউ কাঁদায়নি ! „
“ আমি ছোটমাকে কাঁদিয়েছি ? মুখ সামলে কথা বল শুভো । „
“ ওওও , এখন সত্যিটা শুনে গায়ে লাগছে খুব। তাইতো ! আমি দেখেছি মাকে তোর জন্য চোখের জল ফেলতে …….
এই দুজনের এইভাবে কথা বলা শুনে আকাশের মা বুঝতে পারলেন যে কি হচ্ছে। তিনি বুঝতে পেরে সুচির মায়ের পাশে গিয়ে ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বললেন এবং যা হচ্ছে তা হোক , এরকম একটা ইশারা করলেন।
এদিকে সুচির বাবা জিজ্ঞাসা করলেন , “ আমার জন্য চোখের জল ফেলতো ? „
“ তোর মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় মা চোখের জল ফেলতো। শেষ জীবনে তোর মুখ থেকে একবার ‘ ছোটমা , বলে ডাক শোনার জন্য চোখের জল ফেলতো । তোর….
আকাশের বাবার কথার বা বলা উচিত একের পর এক অভিযোগের মাঝখানে সুচির বাবা বলে উঠলেন , “ এসব হয়েছে তোর অহংকারী বাবার জন্য। তোর বাবা চাইতো না আমি তোদের সাথে । তুই কিছুই জানিস না তোর বাবা আমার সাথে কেমন ব্যবহার করে ছিল । „
আকাশের বাবা কিছু বললেন না। কিন্তু তার মুখ দেখে সুচির বাবা বুঝতে পারলেন যে সে জানতে চায় । তাই সুচির বাবা বললেন , “ আয় তোর বাবার কীর্তি শোন । „
আকাশের ঠাকুর্দার কীর্তি শোনানোর জন্য সুচির বাবার উৎসাহ তার চোখে মুখে ফুটে উঠলো। তিনি যে এখানে সুচির আর আকাশের সম্মন্ধে কথা বলতে এসছিলেন সেটাই তিনি ভুলে গেলেন। তিনি সোফার ঠিক আগের জায়গায় গিয়ে বসে আবার আকাশের বাবাকে ডাকলেন , “ আয় , বোস । শুনে যা সব। শুনবি বলেই তো আমাকে আটকালি। „
আকাশের বাবা কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। সুচির বাবার কথায় তিনি আগের জায়গায় গিয়ে বসলেন । এদিকে সুচির মা আর আকাশের মাও সোফার এসে বসে পড়লেন। আকাশের বাবা সোফায় বসলে সুচির বাবা বলতে শুরু করলেন —
……… তখন সুচির বাবার বয়স পঁচিশ। সুচি – আকাশ কেউই জন্মায়নি কারন সমরেশ তালুকদার আর শুভাশীষ মিত্রেই বিয়েই হয়নি। সুচির ঠাকুর্দা বিশ্বজিৎ তালুকদার প্রিন্টিং প্রেসে এক দুর্ঘটনায় কোমেরে আঘাত পেয়ে বিছানা নিয়েছেন। বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতা তার নেই। একমাত্র ইনকাম সোর্স বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সুচির বাবা অর্থাৎ সমরেশ তালুকদার বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি চাকরি খুঁজতে শুরু করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সদ্য ডান দিক থেকে বাম দিকে গেছে।
রোজ সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত এদিক ওদিক ঘুরে রাতে বাড়ি ফেরেন সুচির বাবা। সারাদিন কিছু খেয়েছি কি খায়নি তার খোঁজ নেওয়ার একমাত্র লোক ছিলেন আকাশের ঠাকুমা। যখনই আকাশের ঠাকুমা অর্থাৎ সুনীতা দেবী সুচির বাবাকে জিজ্ঞাসা করতেন সারাদিন কিছু খেয়েছে কি না তখনই সুচির বাবা এড়িয়ে গিয়ে বলতেন , “ হ্যাঁ খেয়েছি হোটেলে গিয়ে। „
কিন্তু সুনীতা দেবী বুঝতে পারতেন যে সে মিথ্যা কথা বলছে। কারন হোটেলে গিয়ে খাবে এরকম টাকাই সুচির বাবার ছিল না । আর এটা তিনি খুব ভালো করে জানতেন। নিজের পালিত বড়ো ছেলের কষ্ট দেখতে পেলেন না তিনি । তাই এক রবিবার সকালে আকাশের ঠাকুমা অর্থাৎ সুনীতা দেবী তার স্বামী দেবাশীষ মিত্র কে বললেন , “ আমাদের অফিসে কোন কাজ থাকলে ওকে দাও না। সারা দিন এদিক ওদিক ঘুরে শুকিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। „
আকাশের ঠাকুর্দা বিরক্ত হয়ে বললেন , “ আমার অফিসে ওকে চাকরি দেবো কেন ? „
স্বামীর বিরক্তি গায়ে মেখে রাগী স্বরে সুনীতা দেবী বললেন , “ কারন ও আমার বড়ো ছেলে । তাই। „
“ হুউ , বড়ো ছেলে ! „ বলে একটা ব্যাঙ্গাত্মক হাসি হেসে আকাশের ঠাকুর্দা অর্থাৎ দেবাশীষ মিত্র ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সুনীতা দেবী যে তার নিজের সন্তান শুভাশীষ আর পালিত পুত্র সমরেশের মধ্যে কোন পার্থক্য রাখেন না এটা দেবাশীষ মিত্র কখনোই মেনে নিতে পারেন নি। তার কাছে রক্তের সম্পর্ক সবসময় আগে প্রাধান্য পাবে। পরের ছেলেকে মানুষ করছো করো কিন্তু নিজের ছেলের জায়গায় বসাবে কেন ? তাকে সমান গুরুত্ব দেবে কেন ?
দেবাশীষ মিত্র যে মনে মনে এইধরনের কথা পোষণ করেন এটা সুচির বাবা জানেন না। তিনি ঘরের মেঝেতে খবরের কাগজ বিছিয়ে তাতে বিভিন্ন চাকরির বিজ্ঞাপন খুঁজছিলেন । বিজ্ঞাপন পেলে সেগুলো লাল কালিতে গোল করে দাগ কেটে রাখছিলেন। আর বিজ্ঞাপনে দেওয়া ফোন নাম্বার একটা কাগজে টুকে রাখছিলেন। কয়েকটা নাম্বার লিখে মোড়ের মাথায় টেলিফোনের দোকান গিয়ে সেখান থেকে ফোন করবেন। এটাই তার আজকের প্ল্যান।
ঠিক সেই সময় আকাশের ঠাকুর্দা ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক খবরের কাগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দেখে বিরক্ত হয়ে বললেন , “ কি করে রেখেছো ঘরটায় ! এখানে মানুষ থাকে নাকি ! „
সুচির বাবা অপ্রস্তুত হয়ে উঠে একটা কাঠের চেয়ার এনে বললেন , “ বসুন । ওই চাকরি খুঁজছিলাম । তাই….
কাঠের চেয়ারে বসতে বসতে আকাশের ঠাকুর্দা বললেন , “ চাকরি , হ্যাঁ ওই নিয়েই তোমার সাথে কথা বলবো বলে এসছি। তোমার ছোটমা তোমাকে আমার কোম্পানিতে একটা কাজ পাইয়ে দিতে বললো। করবে নাকি ? „
প্রায় দেড় দুই সপ্তাহ ধরে খুঁজতে থাকা চাকরি এখন নিজে হেটে এসছে দোড়গোড়ায় । সুচির বাবা খুশি হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন , “ কি কাজ কাকা ? „ সুচির বাবা সুনীতা দেবীকে ‘ মা , বলে ডাকলেও যেহেতু নিজের বাবা বেঁচে আছে তাই দেবাশীষ বাবুকে ‘ কাকা , বলেই ডাকতেন ।
“ তোমাকে তো হুট করে হিসাবরক্ষকের কাজ দিতে পারি না। তুমি বরং লড়িতে কতো মাল উঠছে সেটার হিসাব রাখার কাজটা করো । পরে যাতে মালের পরিমাণ নিয়ে গোলযোগ না হয় সেটা দেখবে তুমি। „
সুচির বাবা হাতে চাঁদ পেলেন । কাজটা মোটেই ছোট কাজ নয়। মাইনেও অন্তত ভালোই পাওয়া যাবে তাই তিনি বললেন , “ আমি রাজি । „
আকাশের ঠাকুর্দা একটা মিচকি হাসি হেসে বললেন , “ নেহাত তোমার মা তোমাকে আমাদের হাতে দিয়ে গেছেন । তাই এতো আদিখ্যেতা …..
কথাটা শুনে সুচির বাবার কেমন একটা লাগলো। মনে হলো সামনের চেয়ারে বসে থাকা লোকটা নিজের দম্ভ দেখিয়ে তাকে দয়া করছে। এমনিতেও বাবার এক্সিডেন্ট এর পরে এক টাকাও খরচা করতে রাজি হননি এই দাম্ভিক অহংকারী লোকটা। তাই সুচির বাবা বললেন , “ আপনি আমাকে দয়া করছেন ! „
“ দয়া। হ্যাঁ , তা একরকম বলতে পার। সার্টিফিকেট দেখলাম না , ইন্টারভিউ নিলাম না। হুট করে একটা কাজে ঢুকিয়ে দিলাম , তা দয়া তো বটেই ! „
এবার আর সুচির বাবা থাকতে পারলেন না। এমনিতেও বাবার চিকিৎসায় কোন খরচা না করায় লোকটার উপর রেগে আছেন সুচির বাবা । তাই এখন এই দয়াতে খুব রেগে গেলেন তিনি , “ সরি কাকা। আমায় ক্ষমা করবেন । আমি এই কাজ করতে পারবো না। „
মুখের উপর না শুনবেন এটা তিনি আশা করেন নি। তাই কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে থেকে বললেন , “ এই কাজের জন্য বেকার ছেলেরা কাতারে কাতারে আমার অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে । আর তুমি এই কাজ ফিরিয়ে দিচ্ছো ! „
সুচির বাবা গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বললেন , “ ওই কাতারে কাতারে ছেলেদের পিছনে ফেলে , যোগাযোগের মাধ্যমে আমি কাজ করতে পারবো না । আমার ক্ষমা করবেন কাকা । „
এই কথাটা শোনা মাত্রই আকাশের ঠাকুর্দা দেবাশীষ মিত্র রেগে আগুন হয়ে উঠলেন , “ আমার কোম্পানিতে কাজ করতে তোমার এতোই যখন অসুবিধা তখন আমার পরিবারের সাথেও আর মিশো না । „
রেগে অপমানিত হয়ে আকাশের ঠাকুর্দা যখন ঘরে ঢুকলেন তখন সুনীতা দেবী জিজ্ঞাসা করলেন , “ কি বললো ও ? „
গলার সুর উপরে চড়িয়ে আকাশের ঠাকুর্দা বললেন , “ মুখের উপর না বলে দিল তোমার আদরের বড়ো ছেলে । „
সুনীতা দেবী স্বামীর ব্যবহার জানেন। তিনি নিশ্চয়ই উল্টোপাল্টা বলছেন , না হলে সমু এরকম করবে না । তাই তিনিও রেগে গিয়ে সুর উপরে তুলে বললেন , “ তুমিই নিশ্চয়ই কিছু বলেছো ওকে । „
কথাটা বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে গিয়ে একেবারে বড়ো ছেলের কাছে পৌঁছে গেলেন তিনি । সুচির বাবা আবার খবরের কাগজ নিয়ে বসে নিজের কাজ করছিলেন। মা ঘরে ঢুকতেই তিনি উঠে দাড়াতেই সুনীতা দেবী জিজ্ঞাসা করলেন , “ তোর কাকা তোকে কি বলেছে ? „
সব বললে হয়তো ঘরে অশান্তি হবে , তাই সুচির বাবা চেপে গিয়ে বললেন , “ তেমন কিছু না মা। ওই যোগ্য ছেলেদের পিছনে ফেলে আমি চাকরি নেবো না । তাই বলেছি। „
সুনীতা দেবী রেগে গিয়ে বললেন , “ তুই কি বলেছিস সেটা আমি জিজ্ঞাসা করিনি। তোর কাকা কি বলেছে সেটা আমি জিজ্ঞাসা করেছি । „
মাথা নিচু করে সুচির বাবা বললেন “ কিছু বলে নি মা । „
আকাশের ঠাকুমা বুঝতে পারলেন যে সুচির বাবা আর কিছু বলবেন না। শুভোর তখন দেড় কি দুই বছর বয়স আর সমুর প্রায় পাঁচ বছর। তখনই এই ছেলেটার মা ড্যাং ড্যাং করে স্বর্গে চলে গেল। আর যাওয়ার আগে সুনীতা দেবীকে দায়িত্ব দিয়ে গেল। তখন থেকেই দুই ছেলেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন তিনি । তাই তিনি ভালো করেই জানেন যে এই ছেলে একবার যদি না বলার সিদ্ধান্ত নেয় তখন আর বলবেই না। তাই তিনি রেগে গিয়ে ঘরে চলে এলেন।
এতোদূর বলে সুচির বাবা থামলেন। তারপর আবার সুচির বাবা বললেন , “ তুই যখন আমার ছোট মেয়েকে চাকরি দিবি বলেছিলি তখন আমি ভেবেছিলাম তুইও তোর বাবার মতো অহংকারী হয়ে আমাদের দয়া দেখাচ্ছিস। কিন্তু তুই তখন সুচিকে ইন্টারভিউ দিতে বলেছিলি তাই আমি সুচিকে তোর ওখানে ইন্টারভিউ দিতে বলি । না হলে পাঠাতাম না। „
আকাশের বাবা সব শুনে গম্ভীর হয়ে বললেন , “ বাবা যে তোর সাথে এরকম আচরণ করেছিল সেটা তুই মাকে বললি না কেন ? „
সুচির বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন , “ কি বলবো ? বলার পর কি হতো ? আমি ছোটমার জীবনের অশান্তির কারন হতাম । „
“ আর কথাটা না বলে যে তুই মাকে কাঁদিয়েছিস তার বেলা ! কথা বলে সব সমস্যার সমাধান করা যায় । এটা তুই-ই আমাকে ছোটবেলায় বলতিস । আর যখন নিজের জীবনে এটা প্রয়োগ করার সময় এলো তখন নিজেই পিছিয়ে গেলি। মানছি বাবার ভুল ছিল। রাগের বশে উল্টোপাল্টা কিছু বলে বসেছিল । কিন্তু তুই সুস্থ মস্তিষ্কে বারবার মাকে কাঁদিয়েছিস। „
রাগে ফেটে পড়লেন সুচির বাবা , “ বারবার আমার উপর দোষ দিস না শুভো । তোদের মতো অহংকারী বাবা-ছেলে যে বাড়িতে থাকবে সেই বাড়ির মেয়েদের কপালে চোখের জল লেখা থাকবেই । „
এতক্ষন আকাশের ঠাকর্দার কথা হচ্ছিল। এখন আকাশের বাবার উপরেও দোষ পড়াতে তিনি বিস্মিত হয়েছেন সেটা তার কোঁচকানো ভুরু দেখে বোঝা গেল , “ আমি ! আমার অহংকারের কি দেখলি তুই ? „
সুচির বাবা ভাবলেন যে আকাশের বাবা সবকিছু অস্বীকার করছে। তাই বিরক্ত এবং রেগে গিয়ে বললেন , “ কেন ! মনে নেই নতুন গাড়ি কেনার পর তুই আমার সাথে কেমন আচরণ করেছিলি ? „
আকাশের বাবা সত্যি বুঝতে পারছেন না যে সুচির বাবা কোন ঘটনার কথা বলছেন , “ কোন আচরণের কথা বলছিস ? „
সুচির বাবা আবার অতীতের কথা বলতে শুরু করলেন…..
…….. সবে দুই সপ্তাহ হয়েছে সুচির বাবা অফিসের কেরানীর চাকরিটা পেয়েছেন । রোজ সকালে আধপেটা খেয়ে , স্নান করে , বাবাকে খাইয়ে অফিস চলে যান সুচির বাবা। বাড়িতে বাবাকে একা ফেলে যেতে ইচ্ছা করে না তার , তাই অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করেন । তেমনই একদিন বিকালে অফিস থেকে ফিরে বিল্ডিংয়ে ঢুকতে গিয়ে পিছন থেকে তিনি গাড়ির হর্নের আওয়াজ শুনতে পেলেন। পিছন ঘুরে দেখলেন একটা নতুন ফোর্ড কোম্পানির কালো গাড়ি। তার থেকে এলেন শুভাশীষ মিত্র । সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে বাচ্চাকাচ্চারা ছেকে ধরলো।
সুচির বাবার তখন মাথাতে একটাই কথা ঘুরছে , ‘ আমার বাবার চিকিৎসা না করিয়ে কাকা গাড়ি কিনলো ! ,
এইসব কথা যখন সুচির বাবার মাথাতে ঘুরছে তখনই আকাশের বাবা গাড়ি থেকে নেমে সুচির বাবার সামনে এসে চোখের সানগ্লাসটা নাকের ডগায় নামিয়ে , “ দেখলি গাড়িটা ! „বলে উপরে নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে গেলেন ।
এতোটা বলার পরেই সুচির বাবা আকাশের বাবাকে প্রশ্ন করলকরলেন , “এটা বলিস নি বল ? „
আকাশের বাবা চোখ মুখ কুঁচকে চরম বিরক্তি ফুটিয়ে বললেন , “ আরে আমি ওটা ইয়ার্কি মেরে বলেছিলাম। আমি তোর সাথে কতো ইয়ার্কি মারতাম ছোটবেলায় । হঠাৎ ওটাই গায়ে মাখলি কেন ? „
তখন পরিস্থিতি এমনই ছিল যে সুচির বাবা ওই চশমা নাকে নামিয়ে বলা কথাটা অহংকারের স্বরূপ হিসাবে ভাবতে বাধ্য ছিলেন। কিন্তু তিনি এখন বুঝতে পারছেন যে ওটা নিজের ভুল ছিল। কিন্তু তিনি এখন স্বীকার করতে রাজি নন তাই বললেন , “ তাহলে তুই আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলি কেন ? „
এবার রেগে গিয়ে আকাশের বাবা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন , “ কারন তুই শালা মায়ের কাছ থেকে দশ হাজার টাকা ধার চেয়ে মাকে কাঁদিয়েছিল তাই। „
এতক্ষন চুপচাপ এই দুজনের কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ স্নেহা দেবীর মুখ দিয়ে অজান্তে বেরিয়ে এলো , “ দশ হাজার টাকা ! „
“ হ্যাঁ । দশ হাজার টাকা। তুমি তো কিছুই জানো না। বলছি শোন তাহলে এ কি করেছিল ! „
এখন যেন দুজনের মধ্যে প্রতিযোগিতা হচ্ছে। সুচির বাবা , আকাশের ঠাকুর্দা আর আকাশের বাবার কথা বলে বাজিমাত করতে চেয়েছেন। নিজের সব দোষ অস্বীকার করতে চেয়েছেন। তাই এখন আকাশের বাবা সুচির বাবার অতীতের কথা বলে বাজিমাত করতে চান। এরকমই ভাব করে তিনি বলতে শুরু করলেন ।
অতীতের কথা বলা শুরু করার আগেই আকাশের বাবা বুকে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলেন। কারন মায়ের চোখের জলের কথা বলতে গিয়ে তিনি চোখের সামনে দেখতে পেলেন যে মা আঁচল দিয়ে চোখের জল মুচছে । কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে তিনি বলতে শুরু করলেন….
…….. পরপর তিন সপ্তাহ অফিস করে সুচির বাবা বুঝলেন যে বাবাকে একা ঘরে ফেলে যাওয়া উচিত হচ্ছে না। সারাদিন রেডিও শুনেই সুচির ঠাকুর্দা দিন কাটিয়ে দেন। ছেলেকে নিজের অসুবিধার কথা কখনোই বলেন না। অসুবিধার কথা না বললেও সুচির বাবা ঠিক বুঝতে পারতেন সবকিছু। ‘ কি করা যায় ! , এটাই সুচির বাবা সারাদিন ভাবতেন। একদিন সুচির বাবার মুখ দেখে প্রভাস জিজ্ঞাসা করলো , “ এরকম মড়া মুখ করে থাকিস কেন ? „
সুচির বাবা বললেন , “ জানিস-ই তো আমি সকালে অফিস চলে যাই। আসি বিকালে। সারাদিন বাবাকে একা ঘরে ফেলে যেতে কেমন একটা লাগে। কি করবো সেটাই ভাবছি। একটা নার্স যে রাখবো তার টাকাও নেই। „
প্রভাস কৌতুক করে বললো , “ তাহলে ফ্রির নার্স রাখ । „
সুচির বাবা বুঝতে না পেরে বললেন , “ ফ্রির নার্স ! „
প্রভাস হেসে বললো , “ বউয়ের কথা বলছি । „
এতো ভালো আইডিয়া তার মাথাতে কেন এলো না সেটা ভেবেই সুচির বাবা অবাক হলেন। আইডিয়া টা যখন কেউ দিয়েই দিয়েছে তখন শুভস্য শীঘ্রম।
তারপর এদিক ওদিক পাত্রীর খোঁজ করতে লাগলেন সুচির বাবা। কয়েক দিনের মধ্যে পাত্রী পেয়েও গেলেন। নাম সুচেতা মন্ডল। পাত্রী দেখতে যাওয়ার সময় ছোটমাকে নিয়ে যেতে খুব ইচ্ছা হয়েছিল সুচির বাবার। কিন্তু কাকা খারাপ ভাববে এটা ভেবে ছোটমাকে নিয়ে যেতে পারলেন না। দুই জন বন্ধু আর হুইলচেয়ারে করে বাবাকে নিয়ে পাত্রী দেখতে গেলেন সুচির বাবা। পাকা কথা বলে , দিনখন ঠিক করার পর ফিরলেন সবাই।
বিয়ের তারিখ ফাইনাল হয়ে গেলেও পাত্রের পকেটে কানাকড়িও নেই। তাই কারোর কাছে টাকা ধার করার সিদ্ধান্ত নিলেন সুচির বাবা। প্রথমেই মাথাতে এলো ছোটমার কথা। মাথাতে আসতেই ছোটমার কাছে হাজির , “ আমার কিছু টাকা চাই । „
কোন কাজে লাগবে সেটা না জিজ্ঞাসা করে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন , “ কত টাকা ? „
সুচির বাবা বললেন , “ দশ হাজার হলে হয়ে যাবে। আমি মিটিয়ে দেবো অল্প করে অল্প করে । „
কথাটা শুনে সুনীতা দেবীর মাতৃহৃদয় কেঁদে উঠলো। দশ হাজার কেন চাইছে সেটা তিনি জানেন। তার বড়ো ছেলে তাকে কিছু না বলেই পাত্রী দেখতে গেছিল সেটা তার কানেও এসছে। এখন সে বিয়ের জন্য টাকা ধার চাইতে এসছে এটা ভেবেই সুনীতা দেবীর চোখে জল চলে এলো। কোন রকমে চোখের জল আটকে তিনি নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন।
মা আর সুচির বাবার সব কথা আকাশের বাবা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন । মা নিজের ঘরে ঢুকে গেলে আকাশের বাবাও মায়ের পিছন পিছন গিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আলমারি থেকে টাকা বার করে দেওয়ার সময় আকাশের বাবা স্পষ্ট দেখতে পেলেন যে মা কাঁদছে । ঘরের বাইরে এসে আঁচলে চোখের জল মুছে নিয়ে টাকা গুলো নিজের বড়ো ছেলের হাতে দিয়ে দিলেন।
সুচির বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আরও একবার বললেন , “ আমি অল্প অল্প করে মিটিয়ে দেবো সব । „
সুচির বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেই সুনীতা দেবীর চোখের জল আর বাঁধ মানলো না। আর এই চোখের জলের একমাত্র সাক্ষী হয়ে রইলেন বাইশ তেইশ বছরের শুভাশীষ মিত্র। মায়ের চোখে জল দেখে যাকে এতদিন দাদা এবং বন্ধু ভেবে এসেছিল সেই সমুর উপর খুব রাগ হতে লাগলো।
সুচির বাবা নিজের বিয়েতে ছোটমাকে নেমন্তন্ন করার ইচ্ছা থাকলেও কাকার কারনে করতে পারলেন না। আশেপাশের প্রায় পঞ্চাশ ষাট জন বন্ধুবান্ধব কে নেমন্তন্ন করলেও এতদিন যাকে ভাই হিসাবে ভেবে এসছে সেই শুভাশীষ কেও নেমন্তন্ন করতে পারলেন না সুচির বাবা।
দুই দিন পর যখন প্রভাসের মায়ের সাথে সুনীতা দেবী কথা বলছিলেন তখন প্রভাসের মা জিজ্ঞেস করলেন , “ হ্যাঁ বৌমা , তোমরা নেমন্তন্ন পাওনি ? আমার ছেলেটাকে তো সমু বিয়েতে নেমন্তন্ন করলো। „
সুনীতা দেবী বাড়ির কথা বাড়িতেই রাখতে চান। বিয়েতে তার যাওয়ার ইচ্ছা খুব। কিন্তু সেই ইচ্ছা প্রকাশ করলে তার স্বামী দেবাশীষ মিত্র রাগ দেখিয়ে বলেছিলেন , “ নেমন্তন্ন যখন করেনি তখন কোন মুখ নিয়ে যাবে শুনি ! যেতে হবে না কারোর। „
এইসব কথা তিনি বাইরে জানাতে অনিচ্ছুক। তাই তিনি প্রভাসের মাকে বললেন , “ হ্যাঁ করেছে তো। বিয়ের দিন একটা কাজ আছে তাই যেতে পারবো না । „
প্রভাসের মা বুড়ি হয়ে গেছেন। অকপটে সব বলে দেন। এখনও বললেন , “ কেমন মা তুমি ! নিজের ছেলের বিয়েতে যাবে না ….
আজ তার মাতৃত্বের উপর কেউ কথা বললো। একটা মায়ের কাছে কথাটা যে কতটা পীড়াদায়ক সেটা সুনীতা দেবী খুব ভালো করে বুঝতে পারলেন । কথাটা শুনে বুকটা ফেটে গেল তার। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগলো। চোখের জল বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে এলো।
ঠিক তখনই আকাশের বাবা এসে মাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। কিন্তু সুনীতা দেবী সেই যে চোখের জল ফেলা শুরু করলেন তা আর থামল না। আমৃত্যু তিনি চোখের জল ফেলেছেন। আর এইসব চোখের জলের সাক্ষী হয়েছেন একমাত্র আকাশের বাবা। মায়ের চোখের জল দেখতে দেখতে একসময় সমুর উপর ঘৃণা হতে শুরু করেছিল আকাশের বাবার।
এতোটা বলে থামলেন আকাশের বাবা। তার চোখে অশ্রুর ফোটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
কথাগুলো শুনতে শুনতে সুচির বাবা সোফায় বসে পড়েছিলেন। এতক্ষণ পর সবাই সুচির বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো তিনি দুই হাতে মুখ চেপে কাঁদছেন। তিনি যে মাকে এতোটা কষ্ট দিয়েছেন সেটা তিনি জানতেন না। টাকা চাওয়ার পর মা কেঁদেছিল এটাও তিনি জানতেন না। এখন যখন জানতে পারলেন তখন বুকের পাঁজর ভেঙে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো “ মাগো , এ আমি কি করলাম মা। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও মা। তোমাকে আমি কতো কাঁদিয়েছি । কাকার উপর রাগ করে আমি তোমার সাথেও কথা বন্ধ করে দিয়েছিল মাগো। এ আমি কি করলাম মা। এ আমি কি করলাম। „ অবশ্য এই আর্তনাদ কেউই শুনতে পাল না।
কে বলেছে পুরুষ মানুষ কাঁদে না। যখন কোন ছেলে না বুঝে তার মা কে কাঁদায় তখন ছেলেটারও চোখের জল বার হয় বৈকি। এখন যেমন সুচির বাবার চোখের জল বেরিয়ে আসছে।
এদিকে সবকিছু শুনতে শুনতে সুচির মাও কাঁদতে লাগলেন। স্বামীর চোখের জল দেখে তার আরও কান্না পেল। কিন্তু তাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য আকাশের মা আছেন। আকাশের মা সবকিছু শুনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সবকিছু যে এতো ব্যাথা , যন্ত্রনাদায়ক হবে সেটা তিনি ভাবতে পারেন নি। এই ব্যাথার কথা কখনো তার শাশুড়ি তাকে বলেন নি। এখন যে তারও চোখে জল চলে এসছে। বুকটা হাহাকার করছে।
এই ঘটনা এই ফ্ল্যাটে উপস্থিত সকলের চোখ থেকে বেদনার জল বার করে দিল। আকাশের বাবার সাথে পাশের ঘরে শুয়ে থাকা আকাশেরও চোখে জল চলে এসছিল। ঠাকুমাকে কখনো দেখেনি সে। দিদিমাকেই দেখে বড়ো হয়েছে। ঠাকুমার মুখটা কেমন দেখতে ছিল সেটাও সে জানে না। এখন সেই মহিলাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে তার। দিদিমার মতো ঠাকুমাকেও জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে ইচ্ছা করছে তার। মায়ের মুখে সে শুনেছিল যে ঠাকুমার খুব ইচ্ছা ছিল তাকে আদর করার। কিন্তু সে যখন মায়ের পেটে তখন এক্সিডেন্টে ঠাকুমা মারা যায়। তাই আকাশের মুখ ঠাকুমা দেখতে পায় নি। এখন সেই জন্য আকাশের বুকটা কেপে উঠতে লাগলো। যাকে কখনো দেখেনি , তার দুঃখ সে অনুভব করতে পারলো।
কিছুক্ষণ ঘর নিস্তব্ধ থাকার পর সুচির বাবা নিস্তব্ধ ভঙ্গ করে বললেন , “ আমি কি করবো তখন ? বাবার ওই দূর্ঘটনার চিকিৎসার জন্য জমানো সব টাকা খরচ হয়ে গেছিল। কাকাও এগিয়ে আসে নি চিকিৎসার জন্য। কাকা চাইলেই আমার বাবাকে বড়ো হসপিটালে চিকিৎসা করিয়ে ঠিক করিয়ে দিতে পারতেন কিন্তু কাকা এটাকে বেকার অর্থ ব্যায় বলেছিল। তারপরেই কাকার আমার উপর দয়া দেখিয়ে চাকরি দেওয়ার ঘটনা ঘটলো। আমি রেগে গিয়ে চাকরি নিই নি। তারপরেই তুইও অহংকার দেখাতে শুরু করলি। চারিদিকে অন্ধকার দেখছিলাম আমি। তখন প্রভাস বললো বিয়ে করে বউ আন। বিয়ে করবো কিন্তু টাকা ছিল না তাই আমি ছোটমার কাছ থেকে টাকা ধার করেছিলাম । „
আকাশের বাবা একটা ব্যাঙ্গ করে বললেন , “ ধার ! নিজের মায়ের কাছ থেকে টাকা ধার করলি আর সেটা মাসে মাসে মিটিয়েও দিলি। মেয়ের সাথে ব্যাবসা শুরু করেছিলি বুঝি ! „
আকাশের বাবার ব্যাঙ্গ গায়ে না মেখে সুচির বাবা বললেন , “ কাকা চাইতো না আমি তোদের সাথে মিশি । „
“ অন্তত বিয়েতে মাকে নিয়ে যেতে পারতিস । „
“ কতোবার বলবো কাকা চাইতো না এসব। আর কাকা চাইতো না বলেই আমি তোর বিয়েতেও আসতে পারিনি। কিন্তু মায়ের মৃত্যুতে তুই ছোট মাকে এখানে আনলি না কেন ? সোজা নিমতলা নিয়ে গেছিলি কেন ? „
আবার আকাশের বাবা ব্যাঙ্গ করে বললেন , “ ও , তখনও বুঝি তোকে নেমন্তন্ন করতে হতো ! এসো দেখে যা মায়ের মড়া মুখ । „ তারপর শান্ত স্বরে বললেন , “ গাড়ি দুর্ঘটনায় আমি নিজেই মায়ের মুখ দেখতে পারছিলাম না । „
হাতের উল্টো পিঠে চোখের জল মুছে নিয়ে সুচির বাবা বললেন “ আমি তো তোকে সুমির বিয়েতে নেমন্তন্ন করেছিলাম তুই আসিস নি কেন ? „
চুরি করার পর চোর ধরা পড়েলে যেমন মুখ করে ঠিক সেইরকম মুখ করে আকাশের বাবা বললেন , “ আমি এসছিলাম । „
সুচির বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন , “ কখন ? আমি তো তোকে একবারও দেখিনি ! „
তিনি যে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সুমিকে আশীর্বাদ করেছিলেন সেটা তিনি কাউকে জানতে জিতে চান না তাই কথা ঘোরানোর জন্য বললেন , “ তুই আমার ছেলের অন্নপ্রাশনে আসিস নি কেন ? „
এখন এদের কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন দুজনেই নিজের শরীরে লেগে থাকা কাদা অপরের গায়ে ছুড়ে পরিষ্কার হওয়ার চেষ্টা করছে । কিন্তু একটা সময়ের পর দেখা গেল যে সুচির বাবার গায়ের কাদার পরিমান অনেক বেশি তাই তিনি চুপ মেরে গেলেন।
কে কি করেনি ? কে কার কোন অনুষ্ঠানে আসেনি ? এইসব হিসাব করার পর আকাশের বাবা এতদিন জমে থাকা কথা গুলো বলতে শুরু করলেন। যে ব্যাক্তিকে কথা গুলো বলা দরকার সেই ব্যাক্তিই সামনে চুপচাপ বসে আছে। তাই সুযোগ পেয়ে তিনিও মন হাল্কা করতে লাগলেন। কতো কষ্টের কথা , একাকিত্বের কথা , সব বলে আজ তিনি শান্ত হতে যান। তাই তিনি একের পর এক বলে চললেন , “ একবার তুই যদি বাবার কথা মাকে বলতিস তাহলে মাকে এতো কষ্ট পেতে হতো না সমু । „
— তুই জানিস ? তুই যখন অফিস যেতিস তখন মা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতো শুধু একবার তোর মুখ থেকে ‘ আসছি মা , শুনবে বলে । তারপর সুচির মায়ের দিকে ফিরে আকাশের বাবা বললেন , “ জানো বৌদি ! তোমার বিয়েতে তোমাকে প্রান ভরে আশীর্বাদ করার ইচ্ছা ছিল মায়ের । এ সেটাও হতে দেয়নি। সেই সুখটাও এ মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল। „
তখনও সুচির মা কেঁদে যাচ্ছে। এ ইতিহাস জানার থেকে অজানাই যে ভালো ছিল। সুনীতা দেবী তাকে স্নেহ করতো খুব। আকাশের বাবা , ঠাকুর্দা আর তার স্বামী সমরেশ তালুকদার অফিস চলে যাওয়ার পর ঘন্টার পর ঘন্টা একে অপরের সাথে কথা বলে কাটিয়ে দিতেন তারা । সুমি জন্মানোর পর কেন সুনীতা দেবী তাকে কোল ছাড়া করতে রাজি ছিলেন না সেটাও এখন জলের মতো স্পষ্ট তার কাছে। ছোট্ট সুমিকে কতোই না আদর করতো সুনীতা দেবী। কিন্তু কখনোই এইসব কথা সুনীতা দেবী সুচির মাকে বলেন নি। কেন বলেননি সেটা আজ সুচির মায়ের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। সুনীতা দেবী তার বড়ো ছেলেকে কষ্ট পেতে দিতে চাননি। যে কষ্ট এখন সোফায় বসে সুচির বাবা পাচ্ছেন সেই কষ্ট সুনীতা দেবী দিতে চান নি। কিন্তু এক না একদিন আসল ঘটনা চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। আজকেও এসে দাঁড়িয়েছে। আর সুচির বাবাকে কাঁদিয়ে চলেছে।
এদিকে আকাশের বাবা মন শান্ত করতে ব্যাস্ত , “ তুই অন্তত আমাকে তো বলতে পারতিস বাবার কথা। তুই তারপর মায়ের সাথে কথা বন্ধ করে দেওয়ায় মা কাঁদতো খুব। আর সেটা দেখে তোর উপর আমার রাগ বেড়েই যেত। মাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর তুই যখন দশ হাজার টাকার কিস্তি মেটাতে আসতিস সেদিন রাতে মা ঘুমাতে পারতো না। চোখের জল ফেলতো শুধু। মা শুধু একবার তোর কাছ থেকে বাবাবাবা কি বলেছিল সেটা শুনতে চেয়েছিল । „
—– তোর কথা বন্ধ করে দেওয়ায় আমি আমার সবকিছু হারালাম। একসাথে বড়ো হয়েছি আমরা। একসাথে স্কুলে গেছি , একসাথে কত খেলাধুলা করেছি। সুচিকে যেমন আমার ছেলে জন্মের দিন থেকে পাশে পেয়েছে তেমন তোকেও আমি জন্মের দিন থেকেই পাশে পেয়েছিলাম। তোকে দাদা মানতাম আমি। বন্ধু হিসাবে চলতাম বলে কখনো তুমি করে কথা বলিনি তোর সাথে। কিন্তু তুই যখন আমার সাথে তুমি করে কথা বলতে শুরু করলি তখন তোকে খুব পর লাগতে শুরু করেছিল। নিজের একমাত্র বন্ধুকে হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছিলাম। তোর বিয়ের পরেই আমি অফিসে কাজ করতে শুরু করি তারপর আর কোন কিছু স্বাভাবিক ছিল না সমু। খুব ইচ্ছা করতো তোর সাথে কথা বলি , আগের মতো দুজনে দাবার বোর্ডের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিই । কিন্তু তখনই মায়ের চোখের জলের কথা মনে পড়তো। „ এটা বলে নিজের চোখের কোনায় লেগে থাকা অশ্রু মুছে নিলেন আকাশের বাবা।
— একবার যদি তুই মাকে কিংবা আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করতিস তাহলে আজকে নিজের ভাইয়ের সামনে তোকে হাত জোড় করতে হতো না সমু ……
আরো অনেক কথা হয়তো বলতেন আকাশের বাবা । কিন্তু এ অভিযোগ , এ ব্যাথা অসহ্য হয়ে উঠেছে সুচির বাবার কাছে। তাই তিনি আর থাকতে না পেরে সোফা থেকে উঠে এসে আকাশের বাবাকে আলিঙ্গন করলেন। হঠাৎ করে সুচির বাবা গলা মেলাতে আকাশের বাবা থেমে গেলেন। কিছু বললেন না আর। যদিও সুচির বাবা উচ্চতায় একটু ছোট তবুও আকাশের বাবা একটু ঝুকে যেতে দুজনেই অপরের হৃদস্পন্দন নিজের বুকে অনুভব করতে লাগলেন। কতক্ষণ তারা এইভাবে ছিলেন সেটা জানা নেই । কিছুক্ষণ এইভাবে থাকার পর আকাশের বাবা বললেন , “ একটা সমস্যা আছে । „
ভাইকে বুকে নিয়েই সুচির বাবা জিজ্ঞাসা করলেন , “ কি ? „
“ আমি সঞ্জয় কে কথা দিয়েছি যে ওর মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে দেবো । „
ফিক করে হেসে সুচির বাবা বললেন , “ সে তো তুই হরেন-কেও কথা দিয়েছিলি যে ওকে তুই তোর কোম্পানির ম্যানেজার বানাবি । „
পুরানো কথা মনে পড়তে দুজনেই হেসে উঠলো।
Update 6
সকালে একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙলো সুচির বাবা। প্রায় আটটার দিকে ঘুম থেকে উঠে , বারবার হাই তুলতে তুলতে স্নান সেরে ফেললেন তিনি । রাতে ভালো ঘুম হয়নি তার। রাত তিনটে পর্যন্ত কথা বলার পর সবাই ঘুমিয়েছিল । শুধু তিনি কেন ! সুচি বাদে সবারই একই অবস্থা। সবাই আজ একটু দেরিতেই ঘুম থেকে উঠেছেন। আর আকাশ তো ঘুমালোই না। সুচির মা বাবা চলে যাওয়ার পর নিজের ল্যাপটপ খুলে সিনেমা দেখতে বসে গিয়েছিল সে।
স্নান সেরে স্নানঘর থেকে বেরিয়ে জামা কাপড় পড়তেই সুচির মা চা নিয়ে হাজির , “ খরচার কথা ভেবেছো ? „
সুচির বাবা এটাই ভাবছিলেন। চায়ের কাপে একবার চুমুক দিয়ে বললেন , “ যা জমানো আছে তা দিয়ে , আর একটু এদিক ওদিক করে স্বচ্ছন্দে বিয়েটা হয়ে যাবে । কিন্তু আমি যতদূর শুভো কে চিনি ও আমাকে কোন খরচা করতে দেবে না । „
সুচির মা শেষের কথাটা মানতে পারলেন না , “ তা বললে হয় নাকি ? আমি স্নেহার সাথে কথা বলবো তুমি ভেবো না। „
“ তাই করো। শুভো আমার কথা শুনবে বলে তো হয় না। „
“ কচুরি আর কড়াইশুটির আলুর দম করেছি। এসো । „ বলে স্বামীকে সকালের ব্রেকফাস্ট করাতে নিয়ে গেলেন সুচির মা ।
রাতে সুচিরও ভালো ঘুম হয়নি। আগের দিন পলাশের করা অপমান , দিদির দেওয়া হুমকি , বাড়ি বদলানোর সিদ্ধান্ত , এই সবকিছু যেন ভেতর দিয়ে ভেঙে দিয়েছে তাকে। শুধু বাড়ি বদলালে হবে না ! সাথে নতুন চাকরিও খুঁজতে হবে। এইসব ভাবতে ভাবতে চোখের পাতা কখন এক হয়ে এসেছিল সেটা সুচি বুঝতে পারে নি।
সকালে আগের দিনের মতোই জানালার গ্রিলে দুটো শালিকের কিচির মিচির শব্দে ঘুমটা ভাঙতে সে উঠে বসলো। মাথা ভর্তি অবিন্যস্ত চুল , মুখে প্রাণহীন জেল্লা , শুষ্ক ওষ্ঠ্য আর চোখে একরাশ ক্লান্তির ছায়া নিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ খাটের উপর বসে থেকে নিজের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আরো গভির ভাবে ভাবতে লাগলো সুচি । তখনই কিছু ভাসা-ভাসা কথা সে শুনতে পেলো।
সুচির মা বলছেন — যাওয়ার সময় একবার রাধানাথদাকে রাতে আসতে বলে দিও। তারিখ ঠিক করতে হবে তো !
সুচির বাবা — হ্যাঁ ঠিক বলেছো। যদি বাড়িতে না থাকে তাহলে বৌদিকে বলে আসবো । আর তুমি সুচির কুষ্ঠি খুঁজে রেখো। তখন আবার খুঁজতে বসো না যেন । বলে সুচির বাবা অফিস যাওয়ার জন্য বেরিয়ে গেলেন।
ওদিকে এই উড়ে আসা ভাসা-ভাসা কথা গুলো জুড়ে নিয়ে সুচি আর এক সিদ্ধান্তে এলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে এমনিতেই মাথাটা হাল্কা ছিল। তাই এই কথাগুলো জুড়ে নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসতে বেশি সময় লাগলো না তার । এই কথাগুলো জুড়ে নিয়ে সুচি যে কথাটা বুঝলো সেটা হলো — আমার কুষ্ঠি মানে , আমার বিয়ের তারিখ ! বিয়ে হবে মানে ? ছেলে কোথায় ? ছেলে নিশ্চয়ই সুমি জোগাড় করেছে। হ্যাঁ , ও তো হুমকি দিয়েছিল জামাইবাবু কে ছেলে দেখতে বলবে। তার মানে এর মধ্যেই ছেলেও দেখা হয়ে গেছে। আর পাত্র নিশ্চয়ই আজ রাতেই দেখতে আসবে।
আরও উল্টোপাল্টা কথা ভাবতে সুচির বিন্দুমাত্র সময় লাগলো না। কিন্তু যখন এই সিদ্ধান্তে এলো যে , ‘ তাকে দেখতে আজকে পাত্রপক্ষ আসবে আর রাধানাথ ঠাকুর আজকেই বিয়ের তারিখ ঘোষণা করবে । , তখন সুচি আর কাণ্ডজ্ঞান ঠিক রাখতে পারলো না। বুকটা ধড়াস করে উঠলো। পুরো পৃথিবীটা যেন তার চোখের সামনে ঘুরছে । খাটের উপর বসেই কেপে কেপে উঠতে লাগলো সুচি। মুখটা রক্তশূন্য হয়ে উঠলো। মুখে একটা ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠে উঠলো।
কিসের ভয় ? নিজের বিয়ের হয়ে যাওয়ার ভয় ! নাকি আকাশের থেকে চিরতরে দূরে চলে যাওয়ার ভয় ! নাকি আজীবন এই ভাবে কষ্ট পাবার ভয় ! অন্য কোন ছেলের সাথে সে সুখে থাকতে পারবে না এটা পলাশের সাথে ঘটা ঘটনাই প্রমাণ করে। তাহলে কিসের ভয় ? সেটা সুচি বুঝতে পারলো না।
দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে সে সোজা ছুটলো আকাশের ঘরের দিকে । দৌড়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আকাশের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়লো সুচি। কতদিন পর এই ফ্ল্যাটে ঢুকছে সেটা তার খেয়াল নেই। এদিক ওদিক দেখে নিল একবার। না কেউ নেই।
ফ্ল্যাট ফাকা দেখেই সোজা আকাশের ঘরে ঢুকে পড়লো সুচি। আকাশ তখন সবে একটা সিনেমা দেখা শেষ করে ল্যাপটপটা বন্ধ করেছে। ঘরে ঝড়ের বেগে সুচিকে ঢুকতে দেখেই সে খাট থেকে উঠে দাঁড়ালো। আকাশের কাঁধ ধরে মুখ দিয়ে প্রথম শব্দটা বার করতেই সুচি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো , “ আজকে আমাকে দেখতে আসছে ওরা। তুই বলেছিলি না আমাকে নিয়ে পালাবি। চল আমরা কোথাও পালাই…
এদিকে সুচি যে ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সেটা সুচির মায়ের চোখ এড়ালো না। এইভাবে দৌড়ে বার হয়ে যেতে সুচির মায়ের খুব চিন্তা হলো। তাই সুচি ফ্ল্যাট থেকে বার হতেই তিনি ওর পিছন নিয়ে এই ফ্ল্যাটে এলেন। এসে দেখলেন যে সুচি আকাশের ঘরে ঢুকে গেছে। সুচি আকাশের ঘরে ঢুকতেই আকাশের বাবা স্নান করে কোমড়ে শুধুমাত্র একটা তোয়ালে জড়িয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলেন। আকাশের বাবাকে ওইভাবে দেখে সুচির মা লজ্জা পেয়ে যেদিক থেকে এসছিলেন সেদিকেই আবার চলে গেলেন।
সুচি আকাশের ঘরে দৌড়ে ঢোকার সময় তার পিঠ দেখতে পেয়েছিলেন আকাশের মা। তিনি ঘর থেকে স্বামীর জন্য জামা প্যান্ট নিয়ে এসে সোফায় রাখছিলেন। তাই যখন তিনি দেখলেন যে সুচি দৌড়ে আকাশের ঘরে ঢুকে গেল তখন তিনি ভাবলেন , ‘ হয়তো সুচি ওর বিয়ের খবর পেয়ে খুশিতে আর থাকতে না পেরে আকাশের কাছে এসছে। , এটা ভাবতেই কেন জানি না আজকে আকাশের মায়ের ওদের কথা শুনতে খুব ইচ্ছা হলো। কাল রাতের ঘটনার পর থেকেই নিজেকে হাল্কা মনে হচ্ছে আকাশের মায়ের। একমাত্র ছেলের বিয়ে তে মনটা খুশিতে নেচে উঠছে তার। তার উপর এতদিন পর দুই পরিবারের মিল হয়ে যাওয়ার একটা খুশি তো আছেই।
লিভিংরুমের সোফায় বসে ওই ঘরের কথা শোনা যায় বটে তবে সেটা অস্পষ্ট আর খাপছাড়া। তাই আরও ভালো করে শোনার জন্য প্রায় আকাশের দরজার সামনে চলে এলেন তিনি । ঠিক সেই সময় তিনি দেখলেন যে তার স্বামী বাথরুম থেকে বার হলো আর সুচির মা ঘরে ঢুকতে গিয়েও তার স্বামীকে দেখে আর ঢুকলেন না।
এদিকে তার কানে সুচির কান্না ভেজা গলার আকুতি ভেসে এলো। সুচি বলছে , “ আমি পারছি না তোকে ছেড়ে থাকতে । তুই বলেছিলি তো আমি হ্যাঁ বললেই তুই আমাকে নিয়ে পালাবি। এখন আমি হ্যাঁ বলছি। চল পালাই।
এদিকে আকাশের বাবা বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখতে পেলেন যে তার স্ত্রী ছেলের ঘরে কান পেতে কিসব শুনছে। তিনিও কৌতুহল বশত এসে শুনলেন সুচির কান্না ভেজা গলায় আকুতি ।
সুচির এইভাবে বিনা কারণে বা বলা ভালো অহেতুক চোখের জল ফেলতে দেখে আকাশ হেসে ফেললো। এখন তো আর এইসবের কোন দরকার নেই। আকাশ যে সুচিকে থামাতে যাবে , তাকে বলবে যে , ‘ আর এইসবের দরকার নেই। , কিন্তু সুচি আকাশকে কিছু বলতেই দিচ্ছে না। এটা দেখে আকাশের একটু বেশি হাসি পেল।
আকাশকে হাসতে দেখে সুচির খুব রাগ হলো। আকাশের উপর না , নিজের উপর। এ কি ভুল করলো ! কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে কার কাছে কি বলতে চলে এলো সে ! আর কতো ভুল করবে ! নিজের এইসব ভুলের জন্যেই তো আজ ওর দশা। কেন সে নিজের অনুভূতি গুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না ? কেন ?
আকাশ এখন হাসছে। হসবেই তো। এখন তো সে সবার কাছে হাসির পাত্র। ভোগের পাত্র। এইসব ভাবতেই নিজের উপর রাগ আরও হাজার গুন বেড়ে গেল। আকাশকে মারার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তার হলো না । বরং নিজের গালে চড় মারতে ইচ্ছা করছে। চোখের জল মুছে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য সে ঘুরে দাড়ালো।
এতক্ষণ পর আকাশ কিছু বলার সুযোগ পেল। কিন্তু সুচি তো চলে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ বেগে সুচির কোমড় ধরে তাকে ঘুরিয়ে নিজের কাছে টেনে নিল , “ কোথায় যাচ্ছিস ? আমাকে তো কিছুই বলতে দিলি না । „
সুচি রাগী গলায় বললো , “ ছাড় আমায় । „
“ তুই বললেও আমি আর তোকে ছাড়তে পারবো না। তুই বললি ‘ তোকে আজ ওরা দেখতে আসছে। , কারা আসছে দেখতে ? কে বললো তোকে এ কথা ? „
সুচি সেই রাগী গলায় বললো , “ ছাড় বলছি … তোর সাথে আমার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না । „
আকাশ সুচির কোমড় ধরে তাকে আরও কাছে টেনে নিয়ে বললো , “ প্রশ্নটার উত্তর দে। কে বললো তোকে ? „
এখন আকাশের মুখ আর তার মুখ পুরো সামনাসামনি। আকাশের নাকের গরম নিশ্বাস সুচির মুখে এসে পড়ছে। সুচি মুখটা ডানদিকে ঘুরিয়ে বললো , “ আমি শুনেছি । „
সুচির বাম গালের টোলের উপর চোখ রেখে আকাশ জিজ্ঞাসা করলো , “ কার মুখে ? „
এবার সুচি বুঝতে পারলো যে সে এই কথা শোনেই নি। কথাটা মাথাতে আসতেই সে শান্ত আর স্থির হয়ে গেল । একটু ভেবে নিয়ে সে যে কথাটা শুনেছে সেই কথাটাই বললো , “ আজকে পুরোহিত আসছে আমার কুষ্ঠি দেখতে আসছে। আর বিয়ের তারিখ ঠিক করবে তখন । „
নিজের ঠোঁটের এতো কাছে সুচির গাল। ওই গালে চুমু খেতে খুব ইচ্ছা করছে তার। কিন্তু নিজেকে সামলে সে বললো , “ ঠিক কথা। কিন্তু কার সাথে বিয়ে হবে সেটা শুনেছিস ? „
“ আমি জানি না। হয়তো দিদি জানে । „ ওইভাবে থাকে সুচির একদম ভালো লাগছে না। বুকটা উথাল পাথাল করতে শুরু করেছে , “ ছেড়ে দে বলছি। ভালো লাগছে না আর আমার । „
সুচিকে ছেড়ে দেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তার নেই , “ দেখবি ! কার সাথে তোর বিয়ের তারিখ ঠিক হচ্ছে ? „
সুচি এবার রেগে গেল , “ আমার দেখার ইচ্ছা নেই। প্লিজ তুই আমাকে ছাড়। „ বলে নিজেকে ছাড়ানোর ব্যার্থ চেষ্টা করতে লাগলো।
“ এই দেখ । „ বলে সুচিকে টেনে আলমারির দরজায় লাগানো আয়নার সামনে নিয়ে এলো। তার আয়নার দিকে তাকে ঘুরিয়ে বললো , “ এই ছেলেটার সাথে তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে। „
সুচি বুঝতেই পারলো না যে আকাশ কি বলছে। বুঝতে না পারার জন্য তার ঠোঁটটা হাল্কা খুলে গেল। একবার আয়নায় আর একবার আকাশের দিকে তাকাতে লাগলো। আকাশ সুচির বিস্ময় দেখে সুচির ডান গালে নিজের বাম গাল ঠেকিয়ে , চোখ বন্ধ করে বললো , “ কালকে জেঠু এসছিল তোর আর আমার ব্যাপারে কথা বলতে। বাবা রাজি হয়ে গেছে। „
সুচি এখনও বুঝতে পারছে না যে কি হচ্ছে। হঠাৎ করে সবকিছু এতো বদলে গেলো কি করে ? এ যে অসম্ভব ! বাবা নিজেই তো চাইতো না যে এই ফ্যামিলির সাথে কোন সম্পর্ক হোক। হঠাৎ ! মানে ! কি ? কেন ? কি করে ? এইসব ভাবতে ভাবতে মাথার তালগোল পাকিয়ে গেল।
এই সব প্রশ্নের একটাও উত্তর না পেয়ে , কথাটা যে সত্যি সেটা বিশ্বাস হলো না তার। আকাশ মিথ্যা কথা বলছে ভেবে নিয়ে তার মুখে চরম বিরক্তি ফুটে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো , ‘ আকাশ ইয়ার্কি মারলেও যদি এটা সত্যি হতো তাহলে কি সুন্দর হতো জীবনটা । , কিন্তু একা একটা বাজে ইয়ার্কি। তাই সে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো , “ ছাড় আমায় । ইয়ার্কি মারিস না । „
আকাশ এবার আয়নার মধ্যে সুচির চোখে চোখ রেখে বললো , “ সত্যি বলছি। মায়ের দিব্যি। মা কালীর দিব্যি বলছি কালকে জেঠু এসছিল কথা বলতে। „
আকাশ কখনোই মায়ের নামে মিথ্যা দিব্যি কাটে না। এটা সুচির থেকে ভালো আর কেউ জানে না। তাই মনটা হঠাৎ খুশিতে নেচে উঠলো , “ কি করে ? মানে বাবা ! বাবা বললো আর কাকা রাজি হয়ে গেল ! „
আকাশ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললো , “ না । ব্যাপারটা ওরকম নয় । „
সুচি এবার ঘুরে গিয়ে আকাশের চোখ চোখ রেখ , ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো , “ তাহলে ? „
“ সে অনেক কথা , খুলে বলতে হবে। আপাতত এটা শোন যে আমাদের বিয়ে তে আমাদের মা বাবা সবাই রাজি । „
এতোটা শুনেই দেওয়ালের ওপারে কান পেতে থাকা স্নেহা দেবীর ঠোঁটের লাজুক হাসি আরও চওড়া হয়ে গেল। সেই হাসি দেখে আকাশের বাবা ইয়ার্কি মেরে বললেন , “ বুড়ি হয়ে গেছো। একটু তো লজ্জা করো। নিজের ছেলে মেয়ের গোপন কথা আড়ি পেতে শুনছো । „
আকাশের মা কপট রাগ দেখিয়ে বললেন , “ তুমিও তো শুনছিলে এতক্ষণ । „
যৌবনে তিনি প্রেম করেন নি। দেখাশোনা করেই তার বিয়ে হয়েছিল। তাই আজ নিজের ছেলে , মেয়ের এই কথা ধরনের কথা শুনে তার নিজের যৌবনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তিনি কথা এড়ানোর জন্য বললেন , “ খাবার দাও। অফিস যেতে দেরি হয়ে যাবে । „
আকাশের মায়ের হঠাৎ করে মনে পড়লো হরেনের কথা। হরেনকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার স্বামী। কালকে বিয়ে নিয়ে আলোচনার জন্য ভুলেই গেছিলেন কথাটা। এখন মনে পড়তে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন , “ হরেন কে ? „
হা হা করে হাসতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে ফিক করে হেসে তিনি বললেন , “ হরেন না। ওর নাম ছিল হিরণ পান্ডা । আমার থেকে এক দুই বছরের বড়ো ছিল। আর সমুর থেকে ছোট। ওই সমু আর বড়োরাই ওকে রাগিয়ে হরেন বলে ডাকতো । „
“ আর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ? „
আবার একটু হেসে নিয়ে আকাশের বাবা বললেন , “ আমি ছোট ছিলাম বলে আমার উপর খুব চোটপাট করতো ও। ফাই ফরমাস তো ছিলোই। কিন্তু কখনো অন্যায় কিছু করে নি। তাই বড়ো দাদা মেনে নিয়ে সব করে দিতাম । তখন আমার বয়স ওই পনের কি ষোল। একদিন আমাকে একা পেয়ে ও বলেছিল , ‘ তুই যখন তোর বাবার কোম্পানির মালিক হবি। তখন আমাকে ম্যানেজার রাখবি । আমরা দুজন মিলে চালাবো কোম্পানি। দেখবি দেশে বিদেশে নাম হবে খুব। কোটিপতি হয়ে যাবো। , আমি ওর কথাটাকে ইয়ার্কি হিসাবে নিয়ে “ হ্যাঁ „ বলে দিয়েছিলাম। তারপর থেকে প্রতি বছরে চার পাঁচ বার করে ও কথাটা মনে করিয়ে দিত ।
“ তারপর ? „
“ তারপর আর কি ! ওই ধরনের কথা কেউ রাখে নাকি ! আমিও একদিন না বলে দিলাম। তখনও আমি কোম্পানির মালিক হইনি। তারপর রায়পুর না রাইপুর ওরকম একটা জায়গায় চাকরি পেয়ে চলে যায়। যাওয়ার আগে ও বলেছিল ‘ তুই যদি কথা রাখতি তাহলে আমাকে কলকাতা ছেড়ে যেতে হতো না। , „ কথাটা বলে একটা গভীর নিশ্বাস ছাড়লেন। তারপর জামা প্যান্ট পড়ে খেতে বসে গেলেন।
ওদিকে সুচির বিস্ময়ের সীমা নেই। এখনও সে বিশ্বাস করতে পারছে না। আবার অবিশ্বাস করবে সেটাও পারছে না , “ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ! হঠাৎ করে কি হলো ? „
আকাশ সুচির কোমড় ধরে রাখা নাচার মতো দুলতে দুলতে বললো , “ হঠাৎ করে না। আমাদের জন্মের আগে থেকে। আপাতত এটা শুনে রাখ যে আমাদের দুজনের জন্মানোর আগে জেঠু আর বাবার একটা ঝগড়া হয়েছিল। কাল রাতে সেটা মিটে গেছে। „
এতক্ষণ পর সুচি আকাশের কথা বিশ্বাস করতে করতে শুরু করলো। তার চোখ চকচক করছে। হঠাৎ একটা খুশির শান্তির মিঠে দমকা হাওয়া তার হৃদয় স্পর্শ করলো , “ কিসের ঝগড়া ? „
“ পুরোটা না বললে বুঝতে পারবি না। ওসব ছাড়। এটা ভাব যে আমাদের বিয়ের জন্য আজ পুরোহিত আসছে। „
সুচির হঠাৎ আকাশকে দেওয়া গোধূলির গোলাপের কথা মনে পড়ে গেল। মনে পড়তেই সে রেগে গেল। রাগী স্বরে বললো , “ ছাড় । „
আকাশ সুচির এহেন আচরণের অর্থ বুঝতে পারলো না , তাই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো , “ কি হলো আবার ? „
সুচি নিজের গলার স্বরে রাগ বজায় রেখে বললো , “ কি হবে মানে ! তুই তো গোধূলির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিস। ওর দেওয়া গোলাপ নিচ্ছিস। তাহলে আমার সাথে বিয়ে করছিস কেন ? „
কথাটা শুনে আকাশের বিস্ময়ের সীমা রইলো না , “ গোধূলির দেওয়া গোলাপ ! তুই ওখানে ছিলি ? মানে গোধূলি যখন গোলাপ দিয়েছিল তখন তুই ছিলি ওখানে ? আর তুই দেখছিলি সবকিছু ! „
চোয়াল শক্ত করে সুচি বললো , “ দেখেছি বলে ভুল করেছি মনে হচ্ছে ! „
“ তুই ভুল ভাবছিস । আমি সেটা বলতে চাইনি। „
“ এখন আমি ভুল ভাবছি। গোলাপ নিলি তুই আর ভুল ভাবছি আমি । „
“ শোন আমার কথা।পুরোটা শুনলে বুঝতে পারবি। … „ গোধূলি যখন গোলাপ দিয়েছিল সেই সময় ঠিক কি হয়েছিল সেটা সে বলতে শুরু করলো …..
“ আমি তখন চেয়ারে বসে আছি। মাথায় শুধু ঘুরছে কি করা যায় ! ভেবেছিলাম নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে তোর ব্যাপারে মা বাবার সাথে কথা বলবো। কিন্তু বাবা আমার সব প্ল্যানে জল ঢেলে দিল। তাই ভাবছিলাম প্রথমে মাকে রাজি করাবো। তারপর মাকে নিজের দলে নিয়ে বাবাকে রাজি করাবো। তো এইসবই ভাবছিলাম তখন। হঠাৎ দেখি গোধূলি গোলাপ নিয়ে এসে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো , ‘ হ্যাপি রোজ ডে । ,
“ আমি তো থতমত খেয়ে গেলাম। এদিকে অফিসের সবাই আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। কি করবো সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। অফিসের সবাই তখন আমাদেরকেই দেখছে। গোলাপ না নিলে অফিসের সবার সামনে গোধূলি কে অপমান করা হবে। অফিসের সবাই হাসাহাসি করার একটা বিষয় পেয়ে যাবে। আবার গোলাপটা নিলেও সমস্যা। তখনই মাথায় আইডিয়াটা এলো । আইডিয়াটা আসতেই গোলাপটা নিয়ে বললাম , ‘ থ্যাঙ্ক ইউ । , একটু থেমে সুচির উদ্দেশ্যে বললো , “ তুই হয়তো তখনই দেখেছিস। কিন্তু এরপর কি হয়েছিল সেটা তুই দেখিস নি ….
আকাশের কথার মাঝে সুচি বলে উঠলো , “ কখন ? „
“ বলছি , বলছি। উতলা হোস না …..
“ টিফিন ব্রেকে আমি আর গোধূলি একসাথেই খাই। যখন টিফিন ব্রেক হলো তখন আমি আমার টিফিন কৌটো নিয়ে গোধূলির অফিসে গেলাম। সঞ্জয় আঙ্কেল হাসি মুখে বললো , ‘ তোমরা বসে খাও আমি আসছি । ,
“ সঞ্জয় আঙ্কেল চলে যাওয়ায় আমার সুবিধাই হলো। কিন্তু কিভাবে শুরু করবো সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। আমি যে কিছু একটা বলতে ইতস্তত করছি সেটা গোধূলি আমার মুখ দেখে বুঝতে পারলো । তাই ও বললো , ‘ কিছু বলবে ? ‚
আমি সাহস করে বলেই ফেললাম , “ হ্যাঁ , মানে , ওই গোলাপ নিয়ে আর কি। „
“ গোধূলি হয়তো বুঝতে পেরেছিল যে আমি কি বলতে চাইছি । সেটা ওর মুখ দেখেই বুঝছিলাম , তাই যা বলার তা কোন সংকোচ না করে বললাম , “ খারাপ ভেবো না । তুমি খুব সুন্দর দেখতে। আমার থেকেও ভালো ছেলে তুমি পাবে। আমি তোমাকে ছোট করছি না। আসলে আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। সেও আমায় ভালোবাসে , কিন্তু এখন কথা বন্ধ আছে । খারাপ ভেবো না প্লিজ ! „
গোধূলির মুখ দেখে বুঝলাম যে সে ঠিক আন্দাজ করেছিল আর আমার কথায় তার কোন দুঃখ হলো না সেটাও বুঝলাম। ও বললো , ‘ এতে এতো সংকোচের কি আছে ! সেই মেয়ের নামটা জানতে পারি কি ! ,
“ হ্যাঁ নিশ্চয়ই । ওর নাম সুচিত্রা ….
আমার কথা শেষ করার আগেই ও বললো , ‘ সুচিত্রা তালুকদার ! আমাদের অফিসের ? ,
“ হ্যাঁ , ওই । „
‘ আসলে আমারও তোমাকে কিছু বলার ছিল। ‚ বিনা সংকোচে ও বললো , ‘ আসলে তোমার প্রতি আমার এখনও কোন ফিলিংস জন্মায়নি। হয়তো ভবিষ্যতে জন্মাতো কারন তোমাকে ভালো লাগতে শুরু করেছিলাম। আর ভালো লাগা কখন ভালোবাসায় বদলে যায় সেটা বোঝা যায় না। ,
আমি না জিজ্ঞাসা করে থাকতে পারলাম না , “ তাহলে গোলাপ ? „
“ আমি আমার বাপির কথাতে তোমায় গোলাপ দিয়েছি । বাপি চায় আমি তোমার সাথে রিলেশনে যাই ….
এতোটা শোনার পরেই সুচি রেগে গেলো। ওই সঞ্জয় নামক লোকটার উপর তো ওর ছোটবেলা থেকে রাগ। সঞ্জয়ের জন্যেই দিম্মার মাথা নিচু হয়ে ছিল। তাতে সুচির হাত ছিল এটা সত্য। কিন্তু সুচি যা করেছিল তা ওই সঞ্জয়ের কীর্তিকলাপের জন্যেই। তাই আকাশের কথার মাঝে সে বিরক্ত হয়ে বললো , “ থাক । আর শুনতে চাই না । „
আকাশ বুঝতে পারলো না কিছু , “ কি হলো ? „
“ কিছু না । ছাড়। „ বলে আকাশের বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ঘরের বাইরে আসতেই সে আকাশের মায়ের মুখোমুখি হয়ে গেল। ‘ কাকি এখন তার হবু শাশুড়ি। , এটা মাথাতে আসতেই লজ্জায় সুচির গাল লাল হয়ে উঠলো। দৌড়ে ফ্ল্যাটের বাইরে চলে এলো।
সুচিকে ওইভাবে লজ্জা পেয়ে চলে যেতে দেখে স্নেহা দেবী বললেন “ বোকা মেয়ে একটা। „ কথাটা আকাশের বাবা ছাড়া আর কেউ শুনতে পেল না। তিনি তখন ব্রেকফাস্ট শেষ করে সবে উঠেছেন।
ঘরের বাইরে যেতেই সুচি ভাবলো , ‘ আকাশ যে মিথ্যা বলছে না সেটা নিশ্চিত । কিন্তু আরও নিশ্চিত হতে হবে তাকে। কাকে জিজ্ঞাসা করা যায় ভাবতেই মাথাতে এলো নিজের মায়ের কথা। ,
এটা ভেবেই নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে সুচি দেখলো যে তার মা বাবার খাওয়া এঁটো থালা ধুচ্ছে। সে পিছন থেকে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বললো , “ মা । „
সুচির মা প্রথমে চমকে গেছিলেন। কতদিন পর তার মেয়ে তাকে এইভাবে জড়িয়ে ধরলো। সুচির “ মা „ ডাকে যে একটা জিজ্ঞাসা আছে সেটা বুঝতে পেরে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন , “ কি ? „
সুচি ভীষণ লজ্জা পেতে লাগলো , “ কালকে তোমরা গেছিলে ? „
সুচির মা বুঝতে পারলেন যে মেয়ে কি জিজ্ঞাসা করছে। কিন্তু তিনি মেয়ের সাথে এতোদিন পর মজা করার সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি হলেন না। তাই তিনি অবুঝের মতো জিজ্ঞাসা করলেন , “ কোথায় ? „
কথাটা বলতে গিয়ে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা হলো সুচির , “ আকাশের মা বাবার কাছে । „
“ হ্যাঁ গেছিলাম । কিন্তু কেন জিজ্ঞাসা করছিস সেটা তো বল ? „
এতোটা শোনাই যথেষ্ট , “ না , কিছু না । „ বলে সুচি চলে যেতে চাইলো। লজ্জায় তার মাথা কাটা যাচ্ছে। নিজের মা কে কিভাবে জিজ্ঞাসা করবে যে , ‘ তোমরা কি আমার বিয়ের কথা বলতে গিয়েছিলে ? ,
সুচির চলে যাওয়া দেখে সুচেতা দেবী বুঝলেন যে তার মেয়ে লজ্জা পেয়েছে। তাই তিনি সুচির হাত ধরে আঁটকালেন। সুচি তার দিকে ফিরলে তিনি সুচির কপালে একটা চুমু খেয়ে বললেন , “ ওরা রাজি হয়ে গেছে তোর বিয়ের জন্য। আজকে পুরোহিত আসবে তারিখ ঠিক করতে। „
সুচি আর থাকতে পারলো না। দৌড়ে নিজের ঘরে এসে খাটের উপর প্রায় আছড়ে পড়ে বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে রইলো। তারপর বিছানার এদিক ওদিক করতে করতে লাগলো । নিজে থেকেই হেসে উঠে লজ্জা পেতে লাগলো।
হঠাৎ করে কি থেকে কি হয়ে গেল। কাল রাত পর্যন্ত তার জীবনে এক অমাবস্যার অন্ধকার গ্রাস করে ছিল। আজকে নতুন সূর্য উঠে তার জীবনের প্রতিটা কোনায় আলোর রশ্মি ছড়িয়ে দিল। একে এক সব কথা মনে করতে শুরু করলো সে। আকাশকে দিদির বোঝানো। তারপর কথা বন্ধ করে দেওয়া। কলেজের ফাংশনে গিয়ে পলাশের সাথে পরিচয়। তারপর গোধূলির আকাশকে গোলাপ দেওয়া। তাই রেগে গিয়ে পলাশের সাথে ডেটে যাওয়া। তারপর তো ….
আর ভাবতে পারলো না সুচি। পলাশের উপর রাগে মুখটা বজ্রের মতো শক্ত হয়ে উঠলো। আর সাথে আকাশের উপরও খুব রাগ হলো। কেন সে গোলাপটা নিতে গেল ? ওই জন্যেই তো সে পলাশের সাথে ডেটে গেছিল। এমনকি এক মূহুর্তের জন্য বিছানায় যেতে …
ভাবতেই রাগ আরও বেড়ে গেল । সব হয়েছে আকাশের জন্য । গোলাপটা না নিতেই পারতো। সে আকাশকে একটা শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। , ‘ ওকে শাস্তি দিতে হবে। কি দেওয়া যায় ? কি দেওয়া যায় ? হ্যাঁ… ও গোলাপ নিয়েছিল। আজকে আমাকে গোলাপ দিয়েই প্রোপজ করতে হবে। তাও অফিসের সবার সামনে। ,
এটা ভাবতেই সঙ্গে সঙ্গে আকাশকে ফোন করতে গেল । এতদিন ধরে আকাশকে ফোন না করার জন্য কললিস্টের একদম নিচে আকাশের নাম্বার চলে গেছে । কললিস্টে খোঁজার পর ডাইরেক্ট কনটেক্ট লিস্ট গিয়ে প্রথমেই আকাশের নাম্বার দেখতে পেল। আকাশের নাম A দিয়ে শুরু হওয়ায় ওর নাম্বারটাই প্রথমে আছে।
আকাশ তখন জামা আর ফুল প্যান্ট খুলে স্নানে যাওয়ার তোড়জোড় করছে। ফোন বেজে উঠতেই ফোনটা হাতে নিয়ে সে সুচির নামটা দেখতে পেলো। ফোনটা তুলে কলটা রিসিভ করে জিজ্ঞাসা করলো , “ বল। „
সুচি সরসরি বললো , “ তোকে আজ আমাকে প্রোপজ করতে হবে । „
আকাশ মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলো না , “ মানে ? „
“ মানে টানে কিছু জানি না । তুই ওই মেয়েটার কাছ থেকে গোলাপ নিয়েছিলি , তাই এটা তোর শাস্তি। আজ তুই আমাকে প্রোপজ করবি। তাও আবার অফিসের সবার সামনে। „
আকাশ বুঝতে পারলো না যে এখন প্রোপজের কি দরকার ? বাবা মা জেঠা জেঠি সবাই তো বিয়ের জন্য রাজি। তাই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “ এটার আবার কি দরকার ? সবাই তো রাজি হয়ে গেছে । „
“ রাজি হলে হলো। তুই প্রোপজ করবি। ব্যাস। „ বলে ফোনটা কেটে দিয়ে সুচি আবার বিছানার এপাশ ওপাশ করতে লাগলো । কিছুক্ষণ পর অফিস যেতে হবে এটা মাথাতে আসতেই সে স্নানে চলে গেল ।
এদিকে আকাশ ফোনটা হাতে নিয়েই খাটের উপর ধপ করে বসে পড়লো। এ কেমন মেয়ে ? এতদিন পর যখন সবকিছু ঠিকঠাক চলছে তখন প্রোপজের কি দরকার ? সবাইকে কি জানাতে চায় যে আমাদের বিয়ে হচ্ছে ? শুধু একটা গোলাপ নিয়েছি বলে এতো বড়ো একটা শাস্তি দেবে ? গোলাপ নেওয়ার কারন তো বলেছি। তবে এইসবের কি দরকার ?
এইসব ভাবতে ভাবতে প্রোপজ করতেই হবে , এছাড়া আর কোন রাস্তা নেই। সেটা আকাশ বুঝতে পারলো। তাই সে প্রোপজ করার পদ্ধতি ভাবতে লাগলো , ‘ প্রোপজ করার জন্য কি বলবো ? প্রথমে একটা গোলাপ ফুলের তোড়া কিংবা আংটি হাতে নিয়ে একটা হাটু ভেঙে মাটিতে রেখে বলতে হবে…. কি বলতে হবে ? প্রথমে আংটি দরকার। ,
“ হ্যাঁ , ওই আংটি। মনে পড়েছে । „ বলে ড্রয়ার থেকে সেই মেলায় কেনা আংটিটা বার করলো। আংটি হাতে নিয়ে কতো কিছু ভাবতে শুরু করলো সে। তারপর খালি গায়ে কি বলে প্রোপজ করবে । সেটাই লিখতে বসলো।
এদিকে আকাশের বাবা খেয়ে দেয়ে অফিসের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে এসে আকাশের ঘরে উকি মেরে দেখলেন যে আকাশ খালি গায়ে হাফপ্যান্ট পড়ে কিছু একটা লিখতে ব্যাস্ত , “ অফিস যাবি না ? „
আকাশ খাতার পাতা থেকে মুখ না তুলেই বললো , “ আমি বাইকে যাবো। তুমি চলে যাও গাড়ি নিয়ে । „
ছেলের কথা শুনে তিনি সিড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলেন। জাগুয়ারটা নিচেই পার্ক করা আছে। তাতে চড়ে বসে স্টার্ট দিয়ে সোসাইটির বাইরে চলে এলেন। কিছুদূর আসতেই দেখতে পেলেন সুচির বাবা প্রায় দৌড়ে দৌড়ে চিন্তিত মুখে একটা গলি থেকে বার হচ্ছে । কাঁধে তার অফিস ব্যাগ আর টিফিন কৌটো। তিনি গাড়িটা সুচির বাবার সামনে থামিয়ে , মুখটা কচ্ছপের মতো জানালা থেকে বার করে জিজ্ঞাসা করলেন , “ এখন কোথায় গেছিলি ? „
আকাশের বাবাকে দেখে সুচির বাবার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। এতক্ষণ যে চিন্তার ছাপ তার মুখে ছিল সেটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে গিয়ে , সামনের সিটের দরজা খুলে আকাশের বাবার পাশে বসে পড়লেন। তারপর গলার স্বরে চরম ব্যাস্ততা ফুটিয়ে তুলে বললেন , “ চল , চালা । আজ ড্রপ করে দে আমায় । না হলে দেরি হয়ে যাবে। „
আকাশের বাবা গাড়ি চালিয়ে দিয়ে বললেন , “ কোথায় গেছিলি সেটা এখনও বললি না । „
“ রাধানাথদার কাছে। আজ সন্ধ্যায় আসতে বলেছি বিয়ের দিনখন ঠিক করার জন্য। „
কালকে পাকাপাকি কথা হলো আর আজকেই পুরহিত ডাকাও হয়ে গেল। এতো তাড়া দেখে আকাশের বাবা হেসে জিজ্ঞাসা করলেন , “ এতোক্ষণ কি করছিলি ? „
“ আর বলিস না । গেছিলাম প্রায় আধঘন্টা আগে। গিয়ে বসতেই চা খেতে দিল। তারপর শুরু করলো নিজের দুঃখের কাহিনী। ওর একমাত্র ছেলে পূজা করে না। তাই নিয়ে আধা ঘন্টা কথা বললো। আমিও আর উঠলাম না । বুড়ো হয়ে গেছে। কথা বলার লোক চাই। ভাবছিলাম আজ অফিস যেতে দেরি হয়ে যাবে। তোকে পেয়ে গেলাম । চিনিস তো আমার অফিসের রাস্তা ? „
আকাশের বাবা চুপচাপ সব শুনে বললেন , “ চিনি। হ্যাঁ বুড়ো হয়ে গেছেন । „ তারপর তিনি দেখলেন যে সুচির বাবা তার দিকে তাকিয়ে হাসছেন । সুচির বাবার হাসি দেখে তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন , “ কি ? হাসছিস কেন ? „
ঠোঁটের কোনায় দুষ্টুমির হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে সুচির বাবা বললেন , “ তোর জুলফি। চুল। সাদা হতে শুরু করেছে। „
“ আমার চুলের রং না দেখে নিজের দেখ। তোর মাথাতে তো ফুটবল খেলা যাবে । কটা চুল আছে তা গুনে বলা যাবে। „
সুচির বাবা বললেন , “ সময় কতো তাড়াতাড়ি চলে গেল। „
কথাটা শুনে আকাশের বাবা গুম মেরে গেলেন। সময় কারোর জন্য থেমে থাকে না। একটা ভুল বোঝাবুঝি তাদের সবার জীবন থেকে কতগুলো বছর কেড়ে নিয়ে চলে গেল। কালো জাদু করেও সেই বছর গুলো ফিরিয়ে আনা যাবে না। সত্যি বলতে কি কেউ সেই বছর গুলো ফিরে পেতে চায় ও না। তাহলে যে আকাশ সুচির সুন্দর মিষ্টি ছোটবেলা টা তাদের থেকে কেড়ে নেওয়া হবে।
সুচি স্নান করে , খেয়ে দেয়ে , মেকআপ করে একটা জিন্স আর একটা সাদা শার্ট পড়ে আকাশকে ফোন করলো। আজ নিজের স্কুটিতে না গিয়ে আকাশের বাইকেই যাওয়ার ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠলো।

More বাংলা চটি গল্প

Leave a Comment