চন্দ্রকান্তা – এক রাজকন্যার যৌনাত্বক জীবনশৈলী [২৬]

Written by bourses

[২৬] মানবিকতা

বেশ কিছুদিন আর বসা হয়ে ওঠেনি পর্ণার ডায়রি নিয়ে… মায়ের শরীরটা ক’দিন ভালো যাচ্ছে না… তাই শায়নকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল… মায়ের বাতের ব্যথা তো আছেই… যতই হোক, বয়স হয়েছে… তাও তো এই বয়সেও এখনও অনেকই কর্মঠ মা… মাঝে মাঝে সে ভাবে, মায়ের বয়সে গেলে কি হবে তার… কারণ মা যে ভাবে বড় হয়েছে, যা খেয়েছে আর এখন তারা যা খাচ্ছে, সেটার মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক… এখন তো ভেজাল ছাড়া আর কিছুই পেটে ঢোকে না… উল্টে ভেজালহীন খাবার দিলে নির্ঘাত পেট ছেড়ে দেবে, এমনই এখনকার মানুষগুলোর পেটের অবস্থা হয়ে রয়েছে… হাতের কাজ শেষ করে নিয়েছিল একটু তাড়াতাড়িই… ছেলের সাথে দুপুরের খাবার খেয়ে এঁটো বাসনগুলো আর ধোয় নি ও, অন্যদিন কাজের বউটা আসবে বলে দুপুরেই এঁটো বাসনগুলো একটু জলে ধুয়ে রাখে, যাতে বিকেলে বউটার বাসন মাজতে অসুবিধা না হয়… অবস্য এটাই উচিত বলে পর্ণা মনে করে, যতই হোক, বউটা পেটের তাগিদে তার বাড়ি কাজ করে, তার মানে তো এই নয় যে তাদের খাওয়া এঁটো ভরা বাসন এগিয়ে দেবে মাজতে… কিন্তু আজকে আর ভাল্লাগে না তার… ভাবে, বউ আসার আগেই না হয় ধুয়ে রেখে দেবে’খন…
বিছানায় শুয়ে ডায়রি খুলে ধরে পর্ণা…
.
.
.
১৫ই অগস্ট, বুধবার
আজকে স্বাধীনতা দিবস… সেই হিসাবে দেখতে গেলে সত্যিই কি আমরা সবাই স্বাধীন হয়েছি? অবারিত স্বাধীনতার আস্বাদ কে না চায়?
দেশ নামক শব্দটির অন্তর্নিহিত নির্যাসের ধারার প্রতিটি বিন্দু থেকে গলে পড়ে দেশবাসীর তীব্র আবেগের উষ্ণ প্রস্রবণ… ফলে, দেশ এবং তার স্বাধীনতা উদ্যাপনের বিষয়টি দেশের প্রতিটি নাগরিকের কাছেই তাঁর আবেগমথিত-গর্বিত ইতিবৃত্তের এক অনাবিল সুখানুভূতি… যার প্রতিফলন দেখা যায় সমাজের প্রতিটি স্তরে… নাগরিক চেতনার উন্মুক্ত অলিন্দে… ইদানিং কালে আবালবৃদ্ধবনিতার আবেগের পাতা জুড়ে…
ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসের প্রতিটি পাতায় পাতায় লেগে রয়েছে লক্ষ মানুষের আত্মোৎসর্গ, ত্যাগ ও বলিদানের উজ্জ্বল চিরহরিৎ নিশান। অথচ, দেশের স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গীকৃত লক্ষ মহান প্রাণের গর্বিত বলিদানের পরেও আমরা পেয়েছি দ্বিজাতি সত্তার কণ্টকমালায় বিদ্ধ দ্বিখণ্ডিত দেশ এবং তার স্বাধীনতা… যদিও ভারতবাসী হিসাবে নিঃসন্দেহে আমাদের কাছে গর্বিত সুখানুভূতি এই যে, দ্বিখণ্ডিত দেশটার একটা অংশ একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও ভারত নামক বৃহৎ অংশটি সদর্পে এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবেই…
তাই আমাদের ভারত রাষ্ট্রের নিজস্ব কোনও ধর্মীয় বর্ম নেই… বহুত্ববাদের এই ভারতভূমির বক্ষ জুড়ে বহুধর্মের সমন্বয়, বহু ভাষার সমন্বয়, বহুসংস্কৃতির সমন্বয়… বহুত্ববাদের পরম্পরায় গড়ে ওঠা আমাদের এই স্বাধীন ভারতের কোনও নির্দিষ্ট রং নেই… ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনার চিরহরিৎ পাতাগুলো আপামর ভারতবাসীকে গর্বিত করে— “আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র রূপে গড়িয়া তুলিতে, এবং উহার সকল নাগরিক যাহাতে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তার, অভিব্যাক্তির, বিশ্বাসের, ধর্মের ও উপাসনার স্বাধীনতা; প্রতিষ্ঠা ও সুযোগের সমতা নিশ্চিত ভাবে লাভ করেন; এবং তাঁহাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-মর্যাদা ও ঐক্য ও সংহতির আশ্বাসক ভাতৃভাব বর্ধিত হয়; তজ্জন্য সত্যনিষ্ঠার সহিত সংকল্প করিয়া… এই সংবিধান গ্রহণ করিতেছি।”
কষ্টার্জিত এই স্বাধীনতার ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যাওয়ার পরেও প্রশ্নের পর প্রশ্ন কি দলা পাকিয়ে উঠছে না আমাদের চেতনার দেওয়াল বেয়ে? কালের আবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সাধের ভারতরাষ্ট্র কি তার সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলি সুনিশ্চিত করার লক্ষ্য থেকে ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছে না? ভারতকে ‘সমাজতান্ত্রিক’ রাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলার লক্ষ্য থেকে বর্তমানে সমান্তরাল দূরত্ব বাড়িয়ে তোলার নিরন্তর চেষ্টার কতটুকুই বা বিরুদ্ধাচারণ করতে পারছি আমরা?
এই শতাব্দীর নব্যযৌবনের দোরগোড়ার অলিন্দে দাঁড়িয়ে যখন অনুভূত হয় যে, ভারতের সংবিধানের ‘সহজ পাঠ’ প্রস্তাবনা সমূহ এবং মৌলিক অধিকারগুলি বাস্তবিকই অস্তিত্বের সঙ্কটে, তখন আমরা কেবলই ‘নীরব’ থেকে কতটাই বা ‘প্রাউড ইন্ডিয়ান’ হয়ে উঠতে পারছি! তেরঙ্গা জড়িয়ে বা ‘প্রাউড ইন্ডিয়ান’ বলে সদর্পে ঘোষণা করে দেওয়ার হিড়িক দেখে দেশপ্রেমের বন্যা বয়ে চলেছে, এটা ভাবার কোনও যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি আছে বলে কিন্তু একেবারেই মনে হয় না… ‘প্রাউড ইন্ডিয়ান’ হওয়ার প্রাথমিক শর্তটা হল, ভারতের সংবিধানের প্রতি একনিষ্ঠ ভাবে শ্রদ্ধাশীল থাকা… অথচ, প্রায় প্রত্যহ প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলি আমাদের গর্বের সংবিধানের মূল ভিত্তিকে অস্বীকার করার কাজে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিয়েছে এবং তা দেখেও আশ্চর্যজনক ভাবে আমরা ‘নীরব ইন্ডিয়ান’ই থেকে যাচ্ছি… তখনও আমাদের নিজেদের ‘প্রাউড ইন্ডিয়ান’ হিসেবে জাহির করা কি আদৌ গ্রহণযোগ্য?
আমাদের রাষ্ট্র দেশের গৌরবমাখা সংবিধানের প্রস্তাবনার মূল মন্ত্র থেকে ক্রমাগত বিচ্যুত হওয়ার পথে পা বাড়িয়ে চলেছে… তা সে সমাজতান্ত্রিক ভারত গড়ার লক্ষ্যের ক্ষেত্রেই হোক বা ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে অক্ষুণ্ণ রাখার প্রয়াসের ক্ষেত্রেই হোক… একে তেরঙ্গার অপমান বলে মতপ্রকাশ করা হলে দেশদ্রোহিতার গন্ধ খোঁজার ধূর্ত কৌশল শুরু হয়ে যাবে না তো?
স্বাধীনতা তো তখনই আপামর ভারতবাসীর কাছে সূর্যালোক নিয়ে আসবে, যখন সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে ভোগ করতে পারবে দেশের আপামর জনতা… যখন আমরা মর্মে মর্মে অনুভব করতে পারি যে, আমাদের কর্মকাণ্ডের শরীর থেকে ক্রমশই খসে পড়ছে সহিষ্ণুতার পোশাকি বর্ম, নুইয়ে পড়েছে বহুত্ববাদের অনির্বচনীয় মন্ত্রের মেরুদণ্ড, তখনও কি আমরা নীরবতার আতস কাঁচে নিজেদের পরিবৃত রেখে ‘প্রাউড ইন্ডিয়ান’ হয়ে থেকে যেতে পারব?
রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা যদি এমন ভাবে এক দিন সত্যি গ্রাস করে তিল তিল করে গড়ে ওঠা ‘বহুজন সুখায় চ, বহুজন হিতায় চ’-র এই মহামানবের দেশের বহুত্ববাদের কাঠামো, সে দিনও আমরা নীরবতার আগুনে ঝলসে ‘প্রাউড ইন্ডিয়ান’ হয়ে বাঁচতে পারব তো?
অসহিষ্ণুতার কদর্য উদাহরণের কালো মেঘে ক্রমশই ছেয়ে যাচ্ছে আমাদের সমগ্র জীবনের চালচিত্র… তা সে সঙ্কীর্ণ ধর্মীয় মেরুকরণের প্রেক্ষিতেই হোক বা রাজনৈতিক অথবা সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্কীর্ণতার প্রেক্ষিতেই হোক… এর মূল্য চোকাতে হবে না তো আমাদের বহু কষ্টার্জিত স্বাধীনতার মূল্যের বিনিময়ে? চরম অসহিষ্ণুতার নির্মম কুঠার বারংবার আছড়ে পড়ছে দেশের বহুত্ববাদের সহিষ্ণুতার কপালে… কোনও এক অজানা শক্তি যেন পাণ্ডুর করে রেখেছে আমাদের সকল সংবেদনশীলতা এবং সচেতনাকে… মনের জানালা দিয়ে হু-হু করে ঢুকে পড়া অস্থির বাতাস ক্রমশই তপ্ত করে তুলছে আমাদের সকল চেতনকে, মননকে…
তবু জেগে থাকে আশা… এই বিভাজনের সামাজিক এবং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মাঝেও যে মিলনের মন্ত্রোচ্চারণের শক্তিতে আমরা বাঁধা পড়ে আছি একই সুতোয়, সেই সর্বশক্তিমান মানবতাবাদের বলিষ্ঠ মন্ত্রোচ্চারণ আজও কিন্তু ঝরে পড়ে প্রতিটি স্বাধীনতা দিবসে তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলনের মুহূর্তে… গুচ্ছ গুচ্ছ সুবাসিত ফুলের রামধনু আঁকা পাপড়ি বেয়ে বেয়ে…
.
.
.
ডায়রির পাতা থেকে মুখ তুলে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায় পর্ণা… চুপ করে ভাবে খানিক… ডায়রির পাতার কথাগুলো আগে কখনও সে এই ভাবে ভেবে দেখেনি… সত্যিই তো… তবে কি আমরা…? অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার বুকের মধ্যে থেকে… ঘাড় ফিরিয়ে দেখার চেষ্টা করে ছেলেটা কোথায়… কেন জানে না পর্ণা, ছেলেটার জন্য একটা অদ্ভুত ভয় চেপে ধরে বুকের মধ্যেটায়… বাবু এখনও কত ছোট… সেও আস্তে আস্তে বড় হবে… কিন্তু কোন সমাজে?
ফের মাথা ফেরায় ডায়রির পানে…
.
.
.
বাড়ি থেকে যেদিন চলে এসেছিলাম, সেদিনই বলে এসেছিলাম আমি, আমি চৌধুরী বাড়ির কোন কিছু নেবো না কখনও, নিজের খরচ আমি নিজেই চালাবো… সেদিন এক বস্ত্রে এক কথায় বেরিয়ে এসেছিলাম বাড়ি ছেড়ে… শুধু মাত্র মেডিকেলএর বইগুলো আর পরণের কিছু জামাকাপড় ছাড়া… বাড়ির সকলের অভিমত ছিল, নতুন মা’কে মেনে নে তিতাস, তুই শুধু শুধু জেদ করিস না… কিন্তু ওদেরকে বোঝাতে পারিনি, আমি নই, জেদ করছেন ওই ভদ্রমহিলা… আমায় বশে আনার সার্থে… যেটা হতে পারে না কখনো… অন্তত আমার রক্তে সে বশ্যতা স্বীকার করে নেবার মানসিকতা নেই… মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলেই এই নয় যে আমায় সকলের অধীনে মাথা নত করে জীবন কাটাতে হবে, এই শতাব্দিতে বাস করে… আমরা আর সেই রাময়ণের যুগে পড়ে নেই যে সৎ মা এসে যেমন চাইবেন, আর আমাকেও ঠিক তেমনই মেনে চলতে হবে, ওনার মর্জি মাফিক, ওনাকে খুশি রাখার জন্য… তার থেকে এই ভালো… উনি ওনার স্বামী সংসার নিয়ে সুখি থাকুন, আমি আমার মত করে সুখি থাকি… সামনে থাকার কোন প্রয়োজন নেই, তাহলে সেই নিরিখে কোন সংঘাতের কোন আবহাওয়াও তৈরী হবার সুযোগ নেই…
অভাব কি সেটা বুঝিনি কখনও… তাই হস্টেলে যখন এসে উঠলাম, তখন সেই মুহুর্তে হাতে কিছু জমানো পকেট মানি থাকলেও, আস্তে আস্তে সেটা নিঃশেষ হতে শুরু করে দিল… কিন্তু ওই যে, আমার জেদ, যখন একবার মুখ ফুটে বলে এসেছি যে বাড়ি থেকে কিছু নেবো না, তখন নেবো নাই… সে যতই অসুবিধা হোক না কেন… আমার তখন একটাই লক্ষ্য, যে করেই হোক মেডিকালটা শেষ করা… কিন্তু সেটা তো আর এমনি এমনি হয়ে যাবে না… সেটা রীতি মত খরচ সাপেক্ষ্য… সেমিস্টার ফীজ্ আগেই এক সাথে দিয়ে দেওয়া ছিল, তাই সে গুলো লাগবে না ঠিকই, কিন্তু তৎসত্ত্যেও, পড়ার তো আরো খরচ আছে…
হস্টেলে ধীরে ধীরে কিছু বন্ধু বান্ধবী তৈরী হতে সময় লাগে নি বেশি দিন… কলেজের কিছু বন্ধুও ছিল এর সাথে, কলকাতারই সবাই বেশির ভাগ, আবার কিছু বাইরেরও… তাদের সাথেই পরামর্শ করে শুরু করে দিলাম সন্ধ্যে বেলায় টিউশন করানো… মেধাবী ছাত্রী ছিলাম বরাবরই, তাই ব্যাচে পড়াতে অসুবিধা হল না আমার… প্রথমে বারোজনএর ব্যাচ দিয়ে শুরু, তারপর আস্তে আস্তে ছাত্র ছাত্রী সংখ্যা বাড়তে লাগলো… শুরুতে একটা তারপর ধীরে ধীরে তিনটে ব্যাচে গিয়ে দাঁড়ালো… আমাদের কলেজের এক ছাত্রীর বাড়িতে বেশ বড়সড় একটা হল ঘরের মত ছিল, সেখানেই পড়াতাম… আমার ব্যাচে হায়ার সেকেন্ডারি আর জয়েন্টএর স্টুডেন্ট পড়তে আসতো… অনেক সময় নিজে স্টুডেন্ট ভালো হলেও অনেকেই পড়াতে পারে না, সেই দিক দিয়ে আমার কোন অসুবিধা ছিল না… আমার ব্যাচে আমার গ্রহণযোগ্যতা ভালোই হয়েছিল বেশ…
হস্টেলেই দু-বেলা খেতে পেতাম, কিন্তু খাওয়াটাই তো সব নয়… প্রয়োজনের অধিক পয়সা খরচ করার উপায় ছিল না তাই… এমনও দিন গেছে, টিউশন সেরে হস্টেলে ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছে… ফিরে দেখি খাবারের সময় পেরিয়ে গিয়েছে… কিচেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে, খাবার আর নেই পড়ে… রাতে শুধু মাত্র জল খেয়ে শুয়ে পড়েছি…
সেদিনও রাতে হস্টেলে ফিরতে দেরী হয়ে গিয়েছিল, যথারীতি খাবার পায়নি আর… ঘরে ঢুকে জগ থেকে জল গ্লাসে ঢেলে নিয়ে শুয়ে পড়ার তাল করছিলাম, আমার দুই রুম মেট, সুচরিতা আর সুজাতা বাইরে থেকে রুমে ঢুকলো, আমায় দেখে সুজাতা চোখ গোল গোল করে জিজ্ঞাসা করল, “কি রে কান্তা? এই এখন ফিরলি নাকি?”
আমি উত্তরে ঘাড় নাড়ি…
“খেয়েছিস?” পাশ থেকে প্রশ্ন করে সুচরীতা…
“ওই আর কি…” বলে এড়াবার চেষ্টা করি ওদের প্রশ্ন…
ওরা দুজনে এগিয়ে এসে আমায় চেপে ধরে, “এটা কি শুরু করেছিস কান্তা? আমরা প্রায় খেয়াল করেছি, রাতে তুই না খেয়ে শুয়ে পড়িস? তোর ব্যাপারটা কি?”
“আরে চাপ নিচ্ছিস কেন… আমার অভ্যাস আছে… ছাড় না…” আমি ওদের কাটাবার চেষ্টা করি প্রশ্নটাকে উড়িয়ে দেবার ছলে…
“না… চাপ আমরা নিচ্ছি না… কিন্তু তুই যদি এই ভাবে চলিস, তাহলে তো তুইই অসুস্থ হয়ে পড়বি… এই ভাবে প্রায় যদি রাতে খালি পেটে জল খেয়ে শুয়ে পড়িস…” সুজাতার গলায় উদবেগের ছোয়া স্পষ্ট…
আমি সুজাতার কাঁধে হাত রেখে ওকে বলি, “আরে ছাড় না… আমার সত্যিই অভ্যেস আছে… আর তাছাড়া আমি এরকমই… এই ধাতুতেই তৈরী… আমার কিচ্ছু হবে না… আমি নিজেকে ঠিক সামলে রাখতে পারি… মাঝে মাঝে উপোস দেওয়া স্বাস্থের জন্য কত ভালো জানিস?” ম্লান হেসে বলে উঠি… সকাল থেকে ক্লাস করা, নিজের পড়া, তারপর টিউশনে গিয়ে এক নাগাড়ে বকবক করে যাওয়া… ভিষন ক্লান্ত লাগে নিজের… ওদের দিকে পেছন ফিরে বিছানা গোছাই শোবার জন্য…
সুচরীতা এগিয়ে এসে আমার বাহু ধরে ঘুরিয়ে নেয় ওর দিকে ফিরিয়ে প্রায় জোর করেই… “তুই যতই এড়াবার চেষ্টা করিস না কেন, আমরা এটা হতে দিতে পারি না কান্তা… আমরা জানি, তুই কারুর কখনও সাহায্য চাইবি না মুখ ফুটে, কিন্তু তবুও, আমরা তো তোর বন্ধু, নাকি? এ ভাবে চললে তোর শরীর ভেঙে যাবে…” তারপর একটু থেমে একবার সুজাতার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলে, “শোন কান্তা, আমরা দুজনে ঠিক করেছি, তোকে রাতের খাবারের কথা চিন্তা করতে হবে না আর… রাতে যদি দেখি তোর আস্তে দেরী হবে, আমরা তোর খাবার এনে রুমে ঢাকা দিয়ে রেখে দেবো… তুই রুমেই খেয়ে নিস…”
সত্যি বলতে কৃতজ্ঞতায় আমার চোখের কোনে জল চলে এসেছিল সেই মুহুর্তে… আমি মুখ ফুটে কিছু বলতে পারি নি… শুধু সুচরীতাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম খানিকক্ষন…
তারপর থেকে এটাই চলে আসছে… ওরা দুজনে একদম শেষের দিকে খেতে যায় ক্যান্টিনে… যেদিন আমি থাকি, সেদিন আমরা তিনজনে মিলে যাই, আর যেদিন আমি এসে পৌছাই না, সেই দিন গুলোতে, ওরা নিজেরা খেয়ে আমার খাবারটা নিয়ে এসে রুমের ঢাকা দিয়ে রেখে দেয়… আমি যাতে ফিরে খাবারটা যাতে পাই… হয়তো ঠান্ডা হয়ে যায় ওই ভাবে রেখে দেওয়ার ফলে, কিন্তু তাও, এটাই বা কে করে কার জন্য?
এই ভাবেই চলছিল… একদিন রাতে ফিরছি… বেশ রাত হয়ে গিয়েছে সেদিন… সেদিনই বেশ কয়েকটা স্টুডেন্ট মাসের ফিজ্টা দিয়েছে আমায়… আমাদের হস্টেলের কাছাকাছি আসতে দেখি ফুটপাথের ধারে একটা জটলা মত… একটু চিৎকার চেঁচামেচি… অন্য সময় হয়তো খেয়াল করতাম না, কিন্তু একে রাত হয়েছে, তার ওপরে গলার স্বর শুনে মনে হলো কোন অল্প বয়সী ছেলে মেয়ের গলা… কৌতুহল বশত এগিয়ে যাই জটলাটার দিকে…
ল্যাম্প পোস্টের আলোর নীচে, ওই আলো আঁধারীর মধ্যেই দেখি তিনটে বাচ্ছা ছেলে, কত বয়স হবে, খুব বেশি হলে এগারো কি বারো… আর ওদের সাথে চারটে বাচ্ছা মেয়ে… ওরাও ওই ছেলেগুলোর বয়সিই নিশ্চয়… প্রত্যেকেরই মাথার চুল রুক্ষ, কতদিন তেল পড়েনি কে জানে? গায়ের পোষাক শতছিন্ন… কোন রকমে নিজেদের শরীরের লজ্জা চাপা দিয়ে রেখেছে ওই পোষাকের আড়ালে… ক্লিশ চেহারাগুলো নিয়েই ওরা নিজেদের মধ্যে খুব মারপিট করছে… ঐ ফুটপাথের ধূলোর মধ্যে সবাই প্রায় গড়াগড়ি খাচ্ছে মারপিট করতে করতে… আশে পাশে কেউ নেই ওদের মারামারি থামাবার… অনেকই দেখলাম দেখছে, কিন্তু রাস্তার ছেলে মেয়েদের মারামারি, কেই বা মাথা গলাতে যায়? তাই পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে নিজেদের গন্তব্যের দিকে অম্লান বদনে…
আমি একটু তফাৎ থেকে শোনা চেষ্টা করলাম ওদের মারামারির বিশয়টা কি নিয়ে… বুঝলাম যে ওদের ঝগড়াটার কারণ হচ্ছে ওরা সম্ভবত কোথাও থেকে কিছু একটা চুরি করে এনে সেটা বেচেছে কারুর কাছে… এখন সেটার ভাগ বাটোয়ারা নিয়েই সমস্যা তৈরী হয়েছে… আর সেটা নিয়েই যত মতান্তর… এবং ফলপ্রসূ, মারামারি…
ততক্ষনে একটা ছেলের নাক দিয়ে রীতি মত রক্ত বেরোতে শুরু করে দিয়েছে… তাও সে হাত চালাচ্ছে গোঁজ হয়ে… আমি ভাবলাম এই ভাবে তো এরা আস্তে আস্তে সমাজ বিরোধী হয়ে উঠবে… এই ভাবেই তো ছোট বয়েস থেকে সমাজ বিরোধী তৈরী হয়… এখন ওরা বুঝতে পারছে না, কিন্তু যেদিন বুঝবে, সেদিন আর ওদের করার কিছুই থাকবে না… ততদিনে দাগী হয়ে নাম উঠে যাবে সমাজের নীচের তলায়…
আমি দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম ওদের দিকে… সামনের একটা ছেলেকে ধরে টেনে সরিয়ে দিলাম… আমায় এভাবে হটাৎ করে ওদের মধ্যে এসে যেতে দেখে ওরা থমকে গেলো… হয়তো আমার ভদ্র পোষাক দেখেই সেটা হবে হয়তো… কারন এই ভাবে ওদের কাছে তো কোন ভদ্রলোক এগিয়ে আসে না… জন্ম থেকেই ওরা ভদ্র সমাজের ব্রাত্য… তথাকথিত ভদ্র সমাজ ওদের এড়িয়েই চলে সচারাচর… এটাই তো দস্তুর…
“এই… তোরা মারামারি যদি বন্ধ করিস, তাহলে আমি তোদের সবাইকে খাওয়াবো… একেবারে পেট পুরে…” আমি ওদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম…
আমার কথা শুনে ওদের ক্ষুধার্ত চোখগুলো যেন চকচক করে উঠল… কিন্তু তারপরেই কেমন অবিশ্বাসী মুখে তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে…
“বিশ্বাস করছিস না তো?” আমি আরো এক পা এগিয়ে যাই ওদের দিকে… প্রায় ওদের জটলার মাঝে গিয়ে দাঁড়াই… “সত্যিই বলছি… তোরা যদি না মারামারি করিস… আমি সত্যিই সত্যিই তোদের খাওয়াবো…”
একটা ছেলে পাশ থেকে জিজ্ঞাসা করে ওঠে, “কেন? কেন খাওয়াবে আমাদের?” ওকে দেখে বেশ মাতব্বর বলে মনে হয় আমার… বোধহয় বয়সেও বাকিদের থেকে একটু বড়ই হবে সে…
ওর কথায় বাকিরাও মাথা নাড়ে… চোখে তাদেরও জিজ্ঞাস্য…
ওই ছেলেটা আবার প্রশ্ন করে ওঠে, “খাওয়ালে কি আমাদের তোমার হয়ে কোন কাজ সালটাতে হবে?”
ওর কথার ধরনে হাসি চাপতে পারি না আমি… মাথা নাড়ি আমি… “না রে… আমার কোন কাজ সালটাবার জন্য তোদের খাওয়াতে চাইছি না…” তারপর নিজের হাসিটাকে কোন রকমে চেপে রেখে জিজ্ঞাসা করি ছেলেটাকে, “কি নাম তোর?”
নাম জিজ্ঞাসা করাতে যেন আরো বেশি করে সাবধানী হয়ে ওঠে… চোখ সরু করে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে, “কেন? নাম জিজ্ঞাসা করছ কেন? তুমি কি পুলিশের লোক?”
দলটার পেছন থেকে এবার একটা মেয়ে এগিয়ে আসে সামনে… তার পোষাকও অন্য সবার মতই একই অবস্থা… জায়গায় জায়গায় এতটাই ছেঁড়া, যে তার মধ্যে দিয়ে রাস্তার আলো ঢুকে গায়ের চামড়া চোখে পড়ে… রুক্ষ চুলগুলো মাথার পাশ থেকে ঝুলে আছে একটা মাকড়সার জালের মত করে… চোখের ওপর থেকে চুলের খানিকটা গোছা সরিয়ে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে মেয়েটি, “তুমি… তুমি ওই খানটায় থাকো না?” বলতে বলতে আঙুল তুলে দেখায় হস্টেলের দিকে…
আমি ইতিবাচক মাথা হেলাই… “হ্যা… চিনিস আমায়?”
“দেখেছি দুই একবার… রাতের দিকে তোমায় ফিরতে এই খান দিয়ে…” উত্তর দেয় মেয়েটি… ফের ঝরে পড়া চুলগুলো চোখের সামনে থেকে সরিয়ে ধরতে ধরতে…
“তুমি ডাক্তার? দিদি?” এবার প্রশ্নটা আসে মেয়েটির পাশ থেকে অন্য একটা ছেলের থেকে…
“এখনও নই… কিন্তু ডাক্তারি পড়ছি…” হেসে উত্তর দিই…
“ওই হোলো… পড়তে পড়তেই তো ডাক্তার হয়ে যাবে…” বলে ওঠে ছেলেটি… “তাহলে তুমি আমাদের ডাক্তার দিদি…”
আমি ওদের কথা শুনে ভাবি, কত সহজে এরা একটা সম্পর্ক তৈরী করে ফেলে… আর আমরা একটা সম্পর্ক তৈরী করতে গিয়ে শতবার হোঁচট খাই… ভালো মন্দ, সমাজ, ধর্ম, প্রতিপত্তি, জাত পাত, বর্ণ, সব কিছু খুঁটিয়ে বিচার করতে বসি কোন সম্পর্কের মধ্যে ঢুকতে যাবার আগে… অথচ কি নির্দিধায় আমায় দিদি বলে সম্বোধন করে বসলো… আমি হাত বাড়িয়ে ছেলেটির মাথায় রেখে বললাম, “তাহলে? দিদি খাওয়ালে খাবি তো?”
এই ভাবে স্নেহভরা হাত ওদের মাথায় নিতে অভ্যস্থ নয় ওরা… আমার ছোঁয়ায় যেন আনন্দে চকচক করে উঠল ওদের চোখগুলো… এক সাথে সকলে মাথা হেলিয়ে দিলো এক পাশে… “হ্যায়্যায়্যায়্যায়্যা… খাবো…” পরক্ষনেই আর একটি মেয়ে প্রশ্ন করে উঠলো… “কি খাওয়াবে?”
“কি খেতে চাস বল…” আমি ঘুরিয়ে প্রশ্ন রাখি ওদের সামনে…
এই ভাবে চট করে বোধহয় কারুর মাথা থেকেই বেরোয় না কোন খাবারের নাম… আসলে সেই ভাবে তো ভেবে চিনতে কখনও খাবার খাবে বলে ভাবে নি ওরা, যখন যা পেয়েছে, সে যেভাবেই হোক না কেন, সেই দিয়েই উদর পূর্তি ঘটিয়ে এসেছে বরাবর… সেটাই ওদের অভ্যাসে পরিনত হয়ে গিয়েছে আপনা থেকেই… আমার প্রশ্নে মাথা চুলকায় দাঁড়িয়ে…
তারপর মাতব্বর ছেলেটি বলে ওঠে, “কচুরি? কচুরি খাওয়াবে আমাদের?” মুখের ভাবে প্রকাশ পায় যেন বিশাল কিছু একটা নাম বলে ফেলেছে আমায়… একটা আত্মতৃপ্তি খেলা করে সরল নিষ্পাপ মুখের অবয়বে…
“এই এত রাতে কচুরি? পাগল হলি নাকি তোরা?” আমি হাসতে হাসতে বলি… “এখন কচুরি খেলে তো হজমই করতে পারবি না রে… অম্বলে মরবি তো?”
“ও আমাদের হয় না…” হাত উল্টে বলে ওঠে ছেলেটি… “আমাদের পেটের মধ্যে যা ঢোকে, তাই গু হয়ে পরের দিন বেরিয়ে আসে… হা হা হা…”
ওর কথার ধরণ দেখে আমিও হেসে ফেলি, কিন্তু সেই প্রথম মেয়েটি ধমকে ওঠে ছেলেটিকে… “এই… তুই কি রে? দিদিমনির সামনে এই ভাবে কথা বলে কেউ?”
আমি মেয়েটির কথা শুনে অবাক হই… এরা ফুটপাথবাসী হয়েও মানুষকে সন্মান দিতে ভোলে নি… কার সাথে কি ভাবে কথা বলতে হয় সেই সহমর্মিতাটুকু এখনও কেমন এদের মনের অন্তরে বিদ্যমান… দেখে সত্যিই ভালো লাগলো আমার… এরা হয়তো ঠিক মত শিক্ষা পেলে আমাদের মত ভদ্রসমাজের অনেক ছেলে মেয়ের থেকে ভালো মানুষ হতে পারতো… এদের মনের ভেতরের সেই সংবেদনশীলতাটা এখনও মরে যায় নি পরিস্থিতির চাপে পড়ে… এখনও যায় নি, হয়তো এই ভাবেই আস্তে আস্তে সেটা হারিয়ে যাবে… চাপা পড়ে যাবে তথাকথিত সমাজবিরোধী তকমার আড়ালে…
মেয়েটির কথায় ছেলেটি দেখি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে… বোধহয় বুঝতে পারে যে ডাক্তার দিদির সামনে এই ভাবে কথাটা বলা উচিত হয় নি ওর সত্যি… কাঁচুমাচু মুখে তাকায় আমার দিকে…
আমি হাত বাড়িয়ে ওর রুক্ষ চুলগুলোকে নেড়ে দিয়ে বলি, “আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে, এত ভাববার কিছু হয় নি…” তারপর বাকিদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করি, “কি রে? তোরা তোদের নামগুলো তো এখনও বললি না?”
ততক্ষনে ছেলেটির মুখটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে, হেসে বলে, “আমি সুকেশ…” তারপর অন্যদের দিকে ফিরে এক একজনের দিকে আঙুল তুলে চেনাতে থাকে সে, “এ সিরাজ, ও রমেশ, এটা সোনালী, এ টুম্পা, ও গুলি, আর ওই যে, সবার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, ও ফরিদা…”
আমি অবাক হয়ে দেখলাম, এই আমরা ভদ্র সমাজের মানুষগুলো ধর্ম বর্ণ নিয়ে রাজনীতির খেলায় মেতে থাকি, আর এরা, এই পথের শিশুগুলোর মধ্যে সে সব নিয়ে কোন তাপ উত্তাপ নেই… কেমন অদ্ভুত ভাবে এরা মিলে মিশে এক সাথে বড় হয়ে উঠছে… জানি না ভবিষ্যতে এদের মাথা চিবিয়েই হয়তো নেতা নেত্রীরা নিজেদের দল ভারী করে তুলবে… ঝান্ডা বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য…
আমি আর কথা না বাড়িয়ে বললাম, “চল, আজকে তোদের বিরিয়ানী খাওয়াবো…”
“বিরিয়ানীঈঈঈঈঈ?” প্রায় চিৎকার করে উঠলো সমগ্র দলটা সমস্বরে… আনন্দে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না যেন ওরা… দুই একজন তো একেবারে লাফ দিয়ে উঠল নিজের মনের ভাব চেপে রাখতে না পেরে…
ওদের সাথে নিয়ে চললাম রাস্তার মোড়েই একটা ছোট খাবার হোটেল আছে, সেখানে… ওখানেই দেখেছি হোটেলের সামনে লাল শালু জড়ানো বিরিয়ানীর হাঁড়ি রাখা থাকতে… তাই চট্ করে ওটার নামটাই মনে এসে গিয়েছিল…
হোটেলের সামনে পৌছাতে পৌছাতে, দলটা আমায় ছেড়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে হাজির দোকানের গেটের সামনে…
এই ভাবে একদম নোংরা জামাকাপড় পড়া ছেলে মেয়েদের দল এসে ভীড় জমাতে দেখে হোটেলের মালিক হই হই করে উঠল… তাড়াতাড়ি নিজের কাউন্টার ছেড়ে বেরিয়ে এসে ওদের তাড়িয়ে দেবার জন্য হাত তুলতেই আমি এগিয়ে গেলাম… বুঝলাম আমায় প্রথমে খেয়াল করে নি ভদ্রলোক…
আমি এগিয়ে গিয়ে দলটার সামনে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোককে বললাম, “এদের সবাইকে এক এক প্লেট করে বিরিয়ানী দিন তো…”
ভদ্রলোক একটু অবাকই হোলেন আমার কথায়… আমার কথাটাকে আরো একবার নিশ্চিত করতে জিজ্ঞাসা করলেন, “এদের? এদের দেবো?”
আমি ঘাড় নাড়িয়ে বললাম, “হ্যা… এদের… কেন? কোনো অসুবিধা আছে?”
ভদ্রলোক একটু ব্যাজার মুখে দলটাকে দেখলেন, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, “নাহঃ আমার কি অসুবিধা…” বলে পেছন ফিরে একজনকে ডেকে বলে উঠলেন, “হেই পল্টু… এখানে সাত প্যাকেট বিরিয়ানী দিয়ে দে তো…” তারপরই কি মনে করে আমার দিকে ফিরে বলল, “চিকেন হবে, মাটন শেষ হয়ে গেছে…”
আমি হেসে বললাম, “ঠিক আছে… তাতেই হবে… চিকেনই দিন… আর হ্যা, কত হলো?” জানি, আমার পাওয়া ফিজ্ এর অনেকটাই আজকে বেরিয়ে যাবে এর ফলে, কিন্তু ওদের মুখের হাসি দেখে মনে হলো আমার, এর থেকে দামী আর কিছু হয় না… এই মুখের হাসিগুলোর জন্য প্রয়োজন হলে পুরো ফিজ্ এর টাকাটাই দিয়ে দিতে পারতাম আমি…
এরপর যতবার ওদের সাথে আমার যেতে আসতে দেখা হয়েছে, আমায় দেখে হেসে এগিয়ে এসেছে… আমি ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছি… কেমন যেন খুশিতে গলে গিয়েছে ওদের মন গুলো সাথে সাথে… ওই একটু সহমর্মিতা যেন ওদের জীবন যাত্রাটাকেই বদলে দিয়েছে অনেকটাই… আমি কিছুদিন পর ওদেরকে কাছেরই একটা অবৈতনিক স্কুলে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এসেছিলাম… অন্তত নিজের নামের আঁচড়টা তো কাটতে শিখুক… অন্তত আর কেউ যাতে এই নিষ্পাপ শিশুগুলোকে সহজে না ঠকিয়ে নিতে পারে… বিপথে চালিত করতে পারে এদের সহজ নরম মনগুলোকে নষ্ট করে দিয়ে…
.
.
.
“মাআআআ… ও মাআআআ…” শায়নএর ডাকে মুখ তুলে তাকায় পর্ণা… কখন পাশ থেকে ছেলে উঠে গিয়েছে, ডায়রির মধ্যে ডুবে থাকতে থাকতে খেয়ালই করে নি সে…
“হ্যা… বল্…” সাড়া দেয় পর্ণা… বিছানা থেকে উঠে পড়ে সে…
“বাইরে রমা কাকিমা এসেছে… দেখো এসে…”
পর্ণা তাড়াতাড়ি ডায়রিটা বন্ধ করে রেখে এগিয়ে যায় সদর দরজার দিকে…

More বাংলা চটি গল্প

Leave a Comment